নবান্ন নাটকের সঙ্গীত
নবান্ন নাটকে সঙ্গীতে ব্যবহারের সার্থকতা:
সঙ্গীত একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। নাটক যেহেতু মিশ্র শিল্প সেহেতু তার মধ্যে কবিতা এবং আবৃত্তি যোগ্য সংলাপ যেমন থাকতে পারে তেমনি থাকে সঙ্গীতও। অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়েটিকস গ্রন্থে নাটকের যে pleasurable accessories এর কথা বলেছেন সঙ্গীত তার মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন গ্রীক নাটকে কোরাস গানের ব্যবহার, প্রাচীন ভারতীয় নাটকে ধ্রুব রীতির প্রয়োগ বিশেষভাবে স্মরণীয়। সাধারণ সার্থক বাংলা নাটকে একটি সিরিয়াস দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যাওয়ার সময় সঙ্গীত একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত থাকে। অনিবার্যভাবে কোন সিরিয়াস দৃশ্যের চাপ দর্শক সহ্য করতে অনেক সময় পারেন না। তাই মাঝখানে সঙ্গীত চিত্তবিনোদনের কাজ করে। তাছাড়া কথা যেখানে ফুরিয়ে যায় বা কোন ভাব বা বক্তব্যকে যখন কথা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না তখনই গানের প্রয়োজনীয়তা লক্ষণীয়। কিন্তু রবীন্দ্র-নাটক থেকে সঙ্গীত তার একটি বিশেষ রূপ বদল করে। তাঁর নাটকে সঙ্গীত কাব্যধর্মী সাংলাপাতিরিক্ত বক্তব্যের পরিপূরক হিসেবে বা নাটকীয় পরিস্থিতির ইঙ্গিতে বাহী রাগে ব্যবহৃত হয়।
আধুনিককালে নবনাট্য আন্দোলনের পুরোধা জনজীবনের রূপকার বিজন ভট্টাচার্য তাঁর 'নবান্ন' নাটকে সঙ্গীত ব্যবহারের নতুন দিক উন্মোচিত করলেন। যা একেবারে নিজস্ব, একেবারে স্বতন্ত্র শিল্প প্যাটার্ন, যা উঠে এসেছে বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতার গাভীর তলদেশ থেকে। 'নবান্ন' নাটকের মোট চারটি অঙ্কের মধ্যে চতুর্থ অঙ্কেই কেবল সঙ্গীতের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। প্রথম তিনটি অঙ্কে সঙ্গীতের ব্যবহার নেই। আসলে এ নাটক পর্যালোচনা করলে আমরা একটি বিষম উপলব্ধি করতে পারি। তা হল প্রথমে রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবন ছিল ভীত, সন্ত্রস্ত এবং অস্থির। যে জীবনকে শান্তির নীড় হারিয়ে জন্তু-জানোয়ারের মতো বনে জঙ্গলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়। যে প্রাণ শুধু দেওয়ার তাগিদ অনুভব করে, যার সময় কেটে যায় খাদ্যের সারীতে প্রতীক্ষায়- তার গান গাওয়ার অবসর কোথায়? যে জীবন হারু দত্ত, কালীধন ধাড়াদের মতো শক্তি মদমত্ত স্বার্থলিপ্সু হৃদয়হীন মানুষরূপী হায়নার কবলে পতিত হয়ে অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত, যে অন্তর একেবারে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গেছে- তা আজ ম্লান, বিষাদময়। কালোবাজারি, মজুতদারদের দয়ায় শতশত দয়ালকে আজ দুমুঠো অন্নের জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করতে হয়। প্রধান, নিরঞ্জন, বিনোদিনীরা গাঁয়ের ভিটেমাটি ছেড়ে ছুটে আসে মরীচিকাময়ী কলকাতা শহরে। আর শহরের গোলক ধাঁধার ঘূর্ণিপাকে তাদেরকে বিসর্জন দিতে হয় নিজেদের মান-সম্ভ্রম ও ইজ্জতদের। এমনকি করুণা ও প্রেমের প্রতিমূর্তি সেই কুঞ্জ-রাধিকার হৃদয় বৃন্দাবনও আজ শয়তানের পদবিক্ষেপে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত। তাদের কাছে আজ “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি” বলে মনে হয়। এইভাবে ভয়াবহ মন্বন্তর, বন্যা, কদর্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে উৎপীড়িত যে জীবনের হৃদয়াকাশে জমে উঠেছে দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ,, যেখানে গুমরে গুমরে কেঁদে ওঠে সেই মর্ম দহনের তীব্র বেদনার বাণী—
“তোমরা কি সব বধির হয়ে গেছ বাবু
কিছু কানে শোন না? অন্তর কি
তোমাদের পাষাণ হয়ে গেছে বাবু!...
বাবু তোমাদের কি প্রাণ নেই বাবু! ও বাবুরা, বাবু...
ও বাবারা...।” (প্রধান ২/৩)
সেখানে অপূর্ব সঙ্গীত মাধুর্যের আশা করা বাতুলতা নয় কি?
নাট্যকার দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে যে আড়ম্বর পূর্ণ বিবাহ উৎসবের আয়োজন করেছেন সেখানে হয়তো সঙ্গীত ব্যবহারের সুযোগ রয়েছিল। কিন্তু পাশেই ডাস্টবিন থেকে উঠে আসা ক্ষুধার্ত ক্ষুব্ধ, কুকুরের গোঙানি, প্রধানের দুটো অন্নের জন্য বারবার আর্তকন্ঠের কাতর প্রার্থনা ও কুকুরের দংশন জ্বালায় বেদনাবিদ্ধ কুঞ্জের পাশব চিৎকার - এসব বিবাহ উৎসবের জৌলুসকে ছাপিয়ে গিয়ে তাদের নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতাকে তীব্র উপহাস করে না কি? সুতরাং সহমর্মী নাট্যকার স্বভাবতই এখানে সঙ্গীতের আয়োজন বর্জন করেছেন।
অনেকে বলেন যে, গভীর দুঃখেও তো মানুষ গান গাইতে পারে। পারতো, যদি সে দুঃখ দুর্দশাকে মাথা পেতে গ্রহণ করতো, যদি অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠার কোন উদ্বেগ উত্তেজনা তাদের মধ্যে না থাকতো, যদি এখানেই তারা থামিয়ে দিতে তাদের জীবন পথে এগিয়ে চলাকে। তখনই সে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেদনা বিধুর সঙ্গীতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে হাল্কা হতে চাইতো। কিন্তু এরপরও যে রয়েছে যৌথ নেতৃত্বে নিজেদের সুখী ভবিষ্যৎ গড়ার সিদ্ধান্ত। তাই এই নিষ্পেষণ, এই অন্যায় অত্যাচারের আঘাতেই তাদের হৃদয়ে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে বিরুদ্ধ এক জোর প্রতিরোধের তাগিদ। আর এই আশু সমস্যার সমাধানের জন্য জাতিধর্ম নির্বিশেষে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করে। তারা সকলে একসঙ্গে গাঁতায় খাটতে লেগে যায়। নিরঞ্জনরা গ্রামে ফিরে এসে আবার নতুন সংসার বাঁধে। চতুর্থ অঙ্কে উন্মোচিত হয়েছে তাদের নব জীবনের আর এক অধ্যায়। এখানে বাঙালির সঙ্গীত প্রিয়তার কথা নাট্যকার ভোলেন নি। তাই বিরাট সংঘর্ষঘন জীবনপথ বেয়ে নতুনতর ঐক্যের আহ্বানে আনন্দিত নিরঞ্জন আজ এক সুখকর আবেশে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে গান ধরে—
“বড় জ্বালা বিষম জ্বালায়
পুড়ে পুড়ে হব সোনা,
সে কথা তো মিথ্যে হল
হলাম অনুপায়।
দুখের দাহন সুখের আসন
বিজ্ঞজনের হক্ কথা,
শুনে এলাম এই তথ্য
চলতি পথের একতারায়।
হলাম নিরুপায়।।” (৪/১)
এখানে স্বজন হারানো প্রচ্ছন্ন বেদনাবোধের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখদহন পূর্ণ জীবন যে আবার সুখের নীড় খুঁজে পেয়েছে তারই আভাস রয়েছে।
দ্বিতীয় দৃশ্যে তাদের এই জোটবদ্ধ সংগ্রাম এবং পরিশ্রমের প্রাণান্ত চেষ্টায় গৃহ প্রাঙ্গণগুলো ভরে ওঠে সোনার ধানে। এই উপচীয়মান শস্যের গ্রামীণ সুখে কর্মব্যস্ত মানুষগুলো আসন্ন নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি পর্বে মেতে ওঠে। নবজীবনের জয়গান শোনা যায় ফকির ও তার দুই সঙ্গীর মুখ, যারা গানের ধুয়া ধরে চলে—
“আপনি বাঁচলে তো বাপের নাম মিথ্যা সে বয়ান।
হিন্দু মুসলিম যতেক চাষী দোস্তালি পাতান।।
এছাড়া আর উপায় নাই সার বুঝ সবে।
আজও যদি শিক্ষা না হয় শিক্ষা হবে কবে।।” (৪/২)
জাতিভেদ, শ্রেণীভেদ ও স্বার্থপরতা ঘুচিয়ে সকলকে সম্মিলিত হওয়ার আহ্বান জানায় ফকির। এখানে সঙ্গীতটি সময়োপযোগী এবং যুক্তি প্রধান। ভাব নয়, আবেগ নয়, বিরুদ্ধ প্রকৃতির মধ্যে বাঁচতে গেলে লড়তে হবে তার সঙ্গে- সেজন্য ঈশ্বর ভরসায় বসে থাকলে চলবে না। একক মানুষ বড় দুর্বল, সংঘবদ্ধ হয়ে সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করতে পারে। ‘নবান্ন’ নাটকের মর্মবাণী এই গানটিতে অভিব্যক্ত। কারণ অজস্র বাধা এবং সংঘবদ্ধ প্রয়াসে সেই বাঁধা অতিক্রম ‘নবান্নে’র মূল কাহিনী।
তৃতীয় দৃশ্যে নবান্ন উৎসব শুরু হচ্ছে। মরা গঙ্গার ধারে বিস্তীর্ণ উৎসব প্রান্তর গোধূলি আলোয় উদ্ভাসিত। মোরগের লড়াই, গোরু দৌড়, লাঠি খেলা, দ্বন্দ্ব যুদ্ধ প্রভৃতি আয়োজনে মেতে ওঠে গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা। বিগত আকালের ছাপ লাগা মুখে আজ আনন্দোজ্জ্বল রূপ উদ্ভাসিত। ধানের গন্ধ গায়ে মেখে এই কলহাস্যমুখর পরিবেশের শরিক হয়ে ওঠে কৃষক রমণীরাও। শতসহস্র আঘাতও তাদের আনন্দ কেড়ে নিতে পারেনি। মূক প্রাঙ্গণ আজ তাই তাদের গানে মুখর হয়ে ওঠে—
“নিসলো চেয়ে সামনের হাটে গলার হাঁসুলি
ডুরে শাড়ি পাছাপাড় আর হার সাতনলি।
কনে দেখা আলো মেখে আস্বে বঁধূ আলবেয়ে
দেখে হেসে সরে যাবি কথা না কয়ে।।” (৪/৩)
আদি রসাশ্রিত এই গানটিতে চটুল হাস্য পরিহাসের মধ্য দিয়ে অনাড়ম্বর গ্রামীণ মেয়েলি জীবনের স্বাভাবিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। গ্রামীণ উৎসবের উপযোগী এবং যথোপযুক্ত হয়েছে গানটি।
মোরগ লড়াইতে জয়ী ফেকু মিঞাকে ঘিরে সকল জনতা তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে তাকে নিয়ে ছড়া কাটে গানের সুরে—
“(আহা) ফেকু মিঞার মোর জিতেছে।
দেমাক মিঞার দাড়ি ফুলে উঠেছে।
(আহা) ফেকু মিঞার মোরগ জিতেছে।।” (৪/৩)
এখানে একের আনন্দে তারা সকলেই আনন্দিত। ফেকু মিঞার জয় যেন তাদের সমগ্র সংগ্রাম মুখর জীবনের বিজয়বার্তা বহন করে এনেছে। তাই তারা সকলেই উচ্ছ্বসিত, উল্লাসিত, মহাজীবনের আগমনীর আভাসে।
গানগুলি যেন জীবনের অনিবার্য ছন্দে রচিত হয়েছে। এলোমেলো বিবিধ প্রচলিত শব্দগুলোও তুলে এনেছেন নাট্যকার একেবারে গ্রাম্য জীবনের ধূলিধূসর প্রাঙ্গণ থেকে নিজস্ব বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে। যাকে জীবন থেকে আলাদা করে দেখলে মূল্যায়ন ঠিক হয় না। জীবনলগ্ন এই সঙ্গীতগুলিকে নাট্যকার নাটকের মধ্যে সঠিক জায়গাটিতে স্থাপন করে চমৎকারিত্ব বজায় রেখেছেন। গানগুলি নিছক গান হয়ে থাকে নি। থেমে যাওয়া ভাব ও বক্তব্যকে উজ্জ্বলতা দান করেছে, যার সাথে তাল মিলিয়ে নাটকীয় গতিই শুধু তরান্বিত হয়নি। বিজন ভট্টাচার্যও সার্থকতার ধাপে এগিয়ে গেছেন।