মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রিকার জনার চরিত্র
মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রিকার জনার চরিত্র / জনা পত্রিকায় জনার হৃদয় বেদনা / জনা পত্রিকার বিষয়বস্তু
‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ মধুসূদনের জীন সায়াহ্নের পরিণত সাহিত্য কীর্তি। বিষয়বস্তু-রীতি উভয় দিক থেকেই এই কাব্যটি আকর্ষণীয়। কাব্যের আকর্ষণীয়তার পেছনে রয়েছে কয়েকটি পত্ররীতিধর্মী পত্রকবিতা। প্রতিটি পত্রে নারীর বিচিত্র চরিত্র চিত্রিত হয়েছে। এই চরিত্রাঙ্কনে মধুসূদন তার আধুনিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নারীর অন্তঃস্থিত ব্যথা-বেদনাকে সমস্ত সমাজ শাসনের ঊর্ধ্বে গিয়ে লক্ষ্য করতে পেরেছেন। এমনই পত্র কবিতা ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’তে এক নারীর প্রতি তার সহানুভূতি উচ্ছ্বসিত হয়েছে। নারীর হৃদয় ব্যথার পথ ধরে পত্রিকাটির মধ্যে একই সঙ্গে বিদ্রোহ, প্রেম, দুঃখকাতরতা ইত্যাদি ভাবের বৈচিত্র্যপূর্ণ লক্ষণ লক্ষ করা যায়। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ প্রমীলা চরিত্রে এমন ধরণের বিচিত্র ভাবের সমাবেশ ছিল। কিন্তু প্রমীলার চেয়ে জনা চরিত্রটি অনেক বেশি বাস্তব ও মানবিক। পত্রিকাটির ছত্রে মর্মপীড়িতা নারীর হৃদয়ের জ্বালা ও অভিমান প্রকাশিত হয়েছে। এবং তা পাঠক হৃদয়েও সঞ্চারিত হয়েছে। পত্রিকাটি জনার অগ্নিগর্ভ বিলাপের লিখিত রূপ। এই বিলাপে অশ্রু নেই আছে তীব্র চিত্তদাহ। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ কবি করুণ রস ও বীর রসের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এ পত্রিকাতেও এ বীরাঙ্গনার করুন জীবন কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে।
জনা পত্রিকায় যে সংঘাতের কথা আছে তা যেন সনাতন ভক্ত ধর্মের সঙ্গে ক্ষাত্র ধর্মের। জনপ্রিয় পুত্র প্রবীর পাণ্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্বকে ধরেছিল। পরিণামে প্রবল যুদ্ধে এ পার্থের হাতে নিহত হন। কিন্তু তার পিতা নীলধ্বজ পুত্র হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে পরম ভক্তিভরে পরম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু শোকাতুরা প্রবীর জননী জনা স্বামী নীলধ্বজকে ক্ষাত্র ধর্ম অনুযায়ী পুত্র হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করেন।
পত্রের প্রথমেই নীলধ্বজ পাণ্ডবদের আপ্যায়নের জন্য রাজ্যে যে উৎসবের আয়োজন করেছেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তারপর স্বামীর অনুচিত কাজের জন্য এবং পৌরুষহীনতায় জনা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু বুদ্ধিমতী জনা বৃথা ক্রন্দন না করে নিজের মতের সপক্ষে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন। স্বামীকে লজ্জা দিয়ে জ্ঞানোদয় ঘটাবার চেষ্টা করে তাহার কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন। পত্র লেখার কৌশলটি চমৎকার। তিনি প্রকৃত ঘটনা না জানার ভঙ্গিতে লিখেছেন এই উৎসবের আয়োজন তা বোধহয় পুত্র হন্তাকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রার জন্য—‘এই তো সাজে তোমারে, ক্ষাত্রমণি তুমি’ তিনি আরও লিখেছেন—
“যাও বেগে গজরাজ যথা
যমদণ্ডসম শুণ্ড আস্ফালি নিনাদে!”
তিনি এভাবে আঘাত দিয়ে পতির বুকে ক্ষত্রতেজ উদ্দীপ্ত করে প্রতিহিংসানল জ্বালাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আবার পরমুহূর্তেই জনা নিজেই ভেঙে পড়েছেন। তার আক্ষেপ, মর্মদাহ, বিদ্রোহ, হৃদয়ক্রন্দর থেকে সহসা তীব্র বেগে বেরিয়ে এসেছে। প্রতিহিংসা পরায়ণা ক্রুদ্ধ কনিনীর মত তার ভয়ঙ্কর ক্রোধ লেখনীর মাধ্যমে ঝরে পড়তে থাকে। কাপুরুষ স্বামীকে ধিক্কার জানান। এমনকি পাণ্ডব তোষণকারী স্বামীকে তার ভুল ধরাতে গিয়ে পাণ্ডব কূলের ইতিহাসের অপব্যাখ্যা করেন। কুন্তীকে কুলটা বলে অবিহিত করেন। দ্রৌপদী ও ব্যাসদেবের চরিত্রের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করেন। কৃষ্ণার্জুনের প্রতি স্বামীর অবিচলিত ভক্তিকে বিচলিত করার জন্য তাদের বিভিন্ন অন্যায় এবং চরিত্রের বহু দুর্বলতার কথা যুদ্ধের কাহিনীর সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তার এই স্পষ্ট নির্মেদ ভাষার পত্রে তার বীরাঙ্গনা রূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জনা সাধারণ নারীর স্বভাব প্রকৃতির সীমাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। কারণ—
এক।। প্রচলিত ভক্তি বিশ্বাসে আঘাত করতে, কৃষ্ণাশ্রিত অর্জুনকে অবজ্ঞা করতে তিনি সাহস দেখিয়েছেন।
দুই।। সতী বলে কথিত দ্রৌপদী, কুন্তীর সতী পরায়ণতায় তীব্র আঘাত দিয়েছেন।
তিন।। স্বামীকে ধিক্কার দিয়ে যথার্থ ক্ষত্রীয় নারীর মত শত্রুর শক্তিতে ভীত না হয়ে স্বামীকে উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন এবং সে নিজেও উদ্দীপিত হয়েছে।
এসব লক্ষণে জনার বীরাঙ্গনা রূপটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
স্বামী নীলধ্বজকে কৃষ্ণ অর্জুন বা কৃষ্ণার্জুন ভক্তি থেকে বিচলিত করতে বুদ্ধিমতী নারীটি পুত্রের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার বিলাপ যেমন পুত্র মৃত্যুর, আক্ষেপ তেমনি তার স্বামীকে প্রতিহিংসাপরায়ন করে তোলা কৌশল। ট্র্যাজিক চরিত্রের মতই জনার ভবিতব্য। তার আচরণও সেই রকম। কান্নার ধারার সাধারণ নারীর মত আপন হৃদয়ের জ্বালাকে তিনি মুছে দেননি। প্রতিশোধের স্পৃহায় তিনি প্রকৃত ‘বীরাঙ্গনা’র মতই প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে চিরন্তন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার চরম লাঞ্ছনায় অভিলাষ প্রকাশ করেছেন—
“কোন্ সাধে প্রাণ ধরি ধরাধামে?
হায়রে, এ জনাকীর্ণ ভবস্থল আজি
বিজন জনার পক্ষে!”
ট্র্যাজেডির নায়ক-নায়িকা আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেও ব্যর্থ হন। মানব জীবনের নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয়ের শোচনীয় পরিণামের নামই তো ট্র্যাজেডি। নিজের কামনা, বাসনা চরিতার্থ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার চরম লাঞ্ছনায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সেই—‘Doing something terrible” এবং “Suffered something terrible” বিষয় রসই ট্র্যাজেডির উপহাস্য। সেদিক থেকে বলা যায় জনা পত্রিকাটিতে ট্র্যাজেডির লক্ষণ কিছুটা প্রকাশিত হয়েছে। পুত্র হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে জনা একটানা প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সুনিশ্চিত পরাজয় জেনেও প্রচেষ্টা চালানোর মধ্যে ট্র্যাজেডির বীজ লুকিয়ে থাকে। প্রকৃত পক্ষে জনার ট্র্যাজেডি যেন সাধারণ ট্র্যাজিডি নাটকের নায়ক-নায়িকার ট্র্যাজেডির চেও গভীর। একদিকে পুত্রকে হারানো অন্যদিকে পুত্র হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে অপারকতা! জীবনের শ্রেষ্ঠতম আশ্রয় স্বামীও বিমুখ কিন্তু ভারতীয় নারীর আদর্শে স্বামীল উপরেই নির্ভর করতে হয়। তাই স্বামীর চরণে বিদায় প্রার্থনা না করেও মরণেও তার সুখ নেই। আবার স্বামী ও তার মৃত্যুর পরে তাকে কোথা জনা—কোথা জনা বলে ডেকে ডেকে ব্যাকুল হবেন। এ ভাবনাও তার অন্তরকে পীড়া দেয়। শেষপর্যন্ত পাঠক উদ্বিগ্ন, ব্যথিত এবং বিচলিত।
সব দিক দিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ রুদ্ধ হওয়ার পরই জনার চরম পরিণাম এগিয়ে এসেছে। এমন নিদারুণ ভাগ্য বিপর্যয়ের কাহিনী দুর্লভ। তাঁর লড়াই তাঁর মৃত্যুমুখী পরিণাম—এসবই ট্র্যাজেডিয় সংবাদ জাগায়। জনা কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং বীরাঙ্গনা, তার ট্র্যাজেডি খাঁটি হয়েছে। তার মানসিক দৃঢ়তা, নির্ভীকতা, যুদ্ধ বাসনা, স্বামীকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করার সাহস প্রভৃতি চারিত্রিক লক্ষণ তার ব্যক্তিত্বময়ী নারী রূপটি স্পষ্ট করেছে। পরিণামে লাঞ্ছিত ট্র্যাজিক চরিত্র রূপে তিনি উদ্ভাসিত।