-->

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের পত্ররীতির সার্থকতা


 
মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের পত্ররীতির সার্থকতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের পত্ররীতির সার্থকতা

 

সংস্কৃত অলংকারিকেরা বলেছেন—“রীতিরাত্মা কাব্যস্য’’ অর্থাৎ রীতি কাব্যের আত্মা। পরবর্তীকালে এই মত খণ্ডন করলেও কাব্য সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে রীতির যে প্রয়োজনীয়তা আছে তা অস্বীকার করেননি। কারণ কোন আলোকায়া দীপশিখা জ্বালাতে হলে প্রথমে যেমন তেল সোলতে ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হয়, তেমনি সাহিত্যে রস সৃষ্টিতে কোন না কোন রীতি অবলম্বন করতে হয়। কাব্যের গঠন রীতির মধ্যদিয়ে কাব্যের ব্যক্তিসত্তা ও যুগসত্তা যুগ্মভাবে প্রকাশিত হয়। তাই কাব্য বিচারে রীতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ মাইকের মধুসূদন দত্ত একটি বিশেষ রীতিকে আশ্রয় করেছেন, সেই রীতিটি পত্র কাব্যের রীতি। কবি এই কাব্যের প্রতিটি সর্গের শেষে ‘পত্রিকা কাব্য’ এই অভিধা উচ্চারণ করেছেন। অর্থাৎ কবি স্বয়ং বুঝিয়েছেন প্রতিটি কবিতা এক একটি পত্রিকা, এটিই তাঁর কাব্যের স্টাইল।

পত্রকাব্যের এই রীতির ব্যবহার প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে আংশিক বললেই চলে। তবে মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রাচ্য নয়, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’টির গঠন কৌশলে পাশ্চাত্য রীতি, বিশেষ করে রোমক কবি ওভিদের  The Heroides বাEpistles of the Heroines’ নামক কাব্যের আদর্শকেই অনুসরণ করেছেন। গ্রন্থের ভূমিকাংশে মধুসূদন ‘সাহিত্য দর্পণ’-এর শ্লোক উচ্চারণ করেছেন—“লেখ্যপ্রস্থাপনৈঃ নার্য্যা ভাবতিব্যক্তিরিষ্যতে।।” এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় মধুসূদনের চেতনা; তিনি পাশ্চাত্য ভাবধারায় পুষ্ট হলেও ভারতীয় আদর্শের কথায় ভোলেননি।

পত্ররীতি কবিকে তার বক্তব্য ও ভাব প্রকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। কারণ—

১) এই রীতির সাহায্যের কবি নাটকীয়তা সৃষ্টি করতে পারেন।

২) এর মধ্যে বাস্তবতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা আনা সম্ভব হয়।

৩) গভীর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলি এতে প্রকাশ করা সম্ভব।

৪) এই রীতিতে দীর্ঘ বর্ণনা দেওয়ার অবসর থাকে।

৫) স্মৃতি চারণার ভঙ্গিতে এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গ গেলে দোষনীয় নয়।

৬) এই বিশেষ রীতিটি মানব রস গাড় ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হয়।

৭) সর্বোপরি এই রীতির মাধ্যমে কবি আনতে পারে অভিনবত্ব।

মধুসূদন ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ প্রেমের একান্ত গোপনীয় কথা, অন্য কোন সমস্যার কথা নায়িকাদের নিজ মুখে প্রকাশ করার সংযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এই কাব্য রীতিটির সৃষ্টি করেছেন। তিনি জানতেন পত্ররীতি অতীত নায়িকাদের মনোভাব, চিন্তা-ভাবনা যথাযথ ভাবে প্রকাশ করা কঠিন। বাস্তবতাও এই রীতিতে আনা কষ্টকর ব্যাপার। কবির উক্তিতে নায়িকার কথা ব্যক্ত হলেও প্রত্যক্ষতা ও বাস্তবতা অনেক সময় লঙ্ঘিত হয়। এই কারণে কবি নায়িকাদের হাতে লেখনী তুলে দিয়েছেন। নায়িকারা স্বয়ং তাদের মানসলোকের সংবাদ আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে অনায়াসে। একারণেই কাব্য মানব রসই প্রধান হয়ে উঠেছে।

রোমক কবি ওভিদের কাব্যে একুশ জন নায়িকার একুশটি পত্র ছিল, মধুসূদন একুশ জন নায়িকার মর্মকথাকে প্রকাশ করার ব্যাপারে প্রয়াসী ছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত ষোলটি (এগারোটি সম্পূর্ণ ও পাঁচটি অসম্পূর্ণ) পত্র রচনা করে ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ সমাপ্ত করেন। ওভিদের অনুসরণে রচিত হলেও কাব্যগুণ বিচারে বলা যায় ওভিদের কাব্যকে অতিক্রম করে নিয়েছে মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। সমসাময়িক কালে নারী জাগরণে উদ্দীপনা এ কাব্যে ছাপ ফেলেছে। পত্রগুলিতে এক দিকে রয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জয়গীতি। অন্যদিকে কবি ব্যক্তিগত জাগরণবোধ ও জাতীয় জীবনবোধের মিলিত প্রকাশ। পত্রের আধারে মহাকাব্য ও পুরাণ বর্ণিত নারীদের অতীত স্মৃতি রোমন্থনে, রুদ্ধ ভাবাবেগে, কামনার প্রচণ্ডতা, ধিক্কারে তীব্রতা কিংবা দৃপ্ত আত্মঘোষণা কাব্যের প্রতিটি চরিত্র অভিনব ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কবি নারীদের বিশেষ বিশেষ পরিবেশের মধ্যে স্থাপিত করে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মূল সূত্রটিকে উদ্ঘাটিত করতে চেয়েছেন ফলে কাব্যাঙ্গিকের মধ্যে নাটকীও রস উদ্ভব হয়ে প্রতিটি পত্রিকাকে করে তুলেছেন ঐশ্বর্যমণ্ডিত। এই কাব্যের রীতিটির দ্বারা কবি নাট্য-প্রতিভাকে সার্থকভাবে সমন্বিত করতে পেরেছেন।

‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’র প্রথম পত্রিকা ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা’র পত্রের মাধ্যমে শকুন্তলার হৃদয় বেদনার উচ্ছ্বাস পত্ররীতির ভঙ্গীতে প্রকাশিত হয়েছে। সরলতার প্রতিমূর্তি শকুন্তলার অন্তরের কথা পত্রের মাধ্যমে যেভাবে জানা গেছে তা অন্য কোনভাবে প্রকাশ করা যেত না বলে মনে হয়। ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকায় নায়িকা তারা নিজের মনের মধ্যে পুঞ্জিত অবৈধ কামনার স্রোতকে পত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন বলে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে পাঠকের কাছে। নারী সুলভ লজ্জাকে পদদলিত করে যেভাবে কামনার তীব্রভাব সে ব্যক্ত হয়েছে তা অন্য রীতিতে অসম্ভব। সমাজের সমস্ত প্রকার নিষেধাজ্ঞা করে নিজের মনের দৃপ্তঘোষণা সে পত্রের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছে—

কিন্তু যদি থাকে দয়া, এস শীঘ্র করি!

এ নব যৌবন, বিধু, অর্পিব গোপনে

তোমায়

বীরাঙ্গনায় এগারোটি পত্রিকার বিচিত্র রসের সমাবেশ ঘটেছে নারীজনের বিচিত্র অনুভবের মধ্য দিয়ে। কোথাও করুণ, কোথাও সান্ত, কোথাও রৌদ্র প্রভৃতি বিচিত্র রসের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে। ‘জনা’ পত্রিকায় জনার প্রতিহিংসা পরায়ণতা, ব্যর্থতার দীর্ঘনিশ্বাস প্রতিটি ছত্রে প্রকাশিত হয়েছে। নারী হৃদয়ে অবরুদ্ধ আলোড়ন তুলে ধরতে পত্ররীতিটি অবশ্য প্রয়োজন ছিল। আপন হৃদয়ের দুঃখ-বেদনা, ক্ষোভ ও জ্বালার কথা একান্ত আপনজনের কাছে প্রকাশ করার উচ্ছ্বাস প্রাগাঢ় ভাবে ধরা পড়েছে। ‘পুরুরবার প্রতি উর্ব্বশী’ পত্রিকায় দয়িতর প্রতি প্রেম নিবেদনের ভাষায় নায়িকার হৃদয়ে সুকোমল মুক্তি উন্মোচিত হয়েছে। প্রেমাস্পদের প্রতি উর্ব্বশী যেভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে পত্ররীতি ব্যতীত অন্যকোন ভাবে সে স্বতঃস্ফূর্ততার ছোঁয়া পাওয়া যেত কি না সন্দেহ রয়েছে। ‘দশরথের প্রতি কেকয়ী’ পত্রিকায় কেকয়ী ঈর্ষা, বিষজ্বালা, নারী মনের অনন্ত প্রদেশে বিচিত্র সংবাদ পত্ররীতির কৌশল ব্যতীত হয়ত পাঠকের কাছে অধরা থেকে যেত।

কবি যখন নায়িকার মনের সংবাদ বা নায়ক-নায়িকার গোপন অন্তরঙ্গের কথা বলেন তখন তাকে বাস্তবের থেকে শতযোজন দূরত্বের সৃষ্টি হয়। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে অপরের মনের গোপন সংবাদ তৃতীয় ব্যক্তি অর্থাৎ কবি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানলেন কি ভাবে? আবার নায়িকার পক্ষে নিজের মুখে নিজের প্রেম সম্পর্কে কামনা জড়িত গোপন সংবাদ ও মনের প্রতিক্রিয়াকে সমস্ত লজ্জাকে দূরে রেখে অপরের কাছে সরাসরি ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু নায়িকা যখন দূরে বসে প্রেমিককে পত্র লেখেন তখন লজ্জা থাকে না। মনের সমস্ত কামনা, বাসনা, প্রেম স্মৃতি, আবেগ, ভালোবাসা, দুঃখ-যন্ত্রণা, অভিমান, অনুরাগ, বিদ্বেষ, ঘৃণা সমস্তয় ব্যক্ত করা সম্ভব হয়। মধুসূদন পত্ররীতি অবলম্বন করে ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’ বাধা-বন্ধনহীন প্রেমের প্রকাশ ফোটাতে পেরেছেন। আর যখন নারী তার হৃদয়কে উন্মোচন করে প্রিয়তমের কাছে মনের কথাকে অন্তরের গোপন কামনার প্রকাশ করে তখনই পত্ররীতি সার্থকতা পায়। ‘বীরাঙ্গনা’য় এই গুণ থাকার জন্য তার পত্ররীতি একটি সার্থক পত্রকাব্য হয়ে উঠেছে।