-->

'বীরাঙ্গনা' কাব্যের ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকায় নিষিদ্ধ প্রেম

 
'বীরাঙ্গনা' কাব্যের ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকায় নিষিদ্ধ প্রেম

‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকায় নিষিদ্ধ প্রেমের বলিষ্ঠ প্রকাশ হয়েছে আলোচনা করো।

বাংলাদেশে নবজাগরণের কালের নব ভাবের প্রতিফলন মাইকেলের নাটক ও কাব্যগুলির মধ্যে লক্ষ করা যায়। তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘শর্মিষ্ঠা’ প্রভৃতি রচনা মধ্যযুগীয় সংস্কারের অন্ধকার থেকে আলোকোজ্জ্বল বাঙালীর নতুন যুগে পদার্পণ সংকেত দেয়। যুগাবতার মধুসূদন সমাজের বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে প্রচলিত ধারা থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। সেই ব্যক্তি স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পেরেছিলেন। সেই ব্যক্তি স্বাধীনতার চূড়ান্ত পরিচয় তাঁর ‘বীরাঙ্গনা কাব্যে’র বলিষ্ঠ প্রেম চেতনার মধ্যে। এই কাব্যের নায়িকারা প্রেম মন্ত্র দীক্ষিত। যে প্রেম সমাজনীতি মেনে চলে না যা হৃদয়াকাঙ্ক্ষার অনুগত। তার বীরাঙ্গনা কাব্যে প্রেমের যে চিত্র পাই তা অনেক ক্ষেত্রেই সমাজ নিষিদ্ধ। বীরাঙ্গনা কাব্যের দ্বিতীয় পত্রিকাটি হল ‘সোমের প্রতি তারা’ নায়িকা তার আপন প্রেমের প্রকাশে অকুতোভয়। তারার যে প্রেম প্রচলিত সামাজিক নীতিকে অবজ্ঞা করেছে। তারার মধ্যে যে অবৈধ প্রেমের প্রকাশ তা বাংলা সাহিত্যে সমাজ বিরোধী প্রেম সম্পর্কের পথ প্রদর্শক, এক্ষেত্রে কবি অবৈধ প্রেমের আনন্দ বেদনার সার্থক রূপায়ন ঘটিয়েছেন।

পুরাণে সোম তারার যে প্রসঙ্গ আছে তাঁকে সম্পূর্ণ নতুন ভঙ্গিতে এঁকেছেন কবি। স্বাধীন নারী চিত্তের যুক্তির কামনা এখানে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। তারা কুলবধূ অথচ তার স্বামীর শিষ্য সোমদেবকে কেন্দ্র করে হয়ে উঠেছেন পাগলিনী। গুরুপত্নী তারা স্বামী শিষ্য সোমদেবের রূপে-গুণে মোহিত হয়েছে। আর সমস্ত প্রকাশ লজ্জা ও নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাঠ সমাপ্তে গৃহাভিমুখী সোমের কাছে পত্র লিখেছেন। সেই পত্রের ছত্রে ছত্রে আছে তার হৃদয়ের দুর্দমনীয় প্রেমাকাঙ্ক্ষা বলিষ্ঠ প্রকাশ। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের কাহিনীতে আছে সোম তারার প্রতি কামমত্ত হয়ে তারাকে বলপূর্বক সম্ভোগ করে ‘গুর্বাঙ্গনাগম’ হয়েছিলেন। সেখানে তারার কোন প্রেমাকাঙ্ক্ষা তো ছিলই না। উপরন্তু তারা সোমকে নিরস্ত্র করতে অসমর্থ হয়ে তাকে কঠিন অভিশাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু নবজাগরণের কবি মধুসূদন আপন প্রতিভা বলে এই কাহিনীটিকে নারী মনের বৃহত্তম বৃত্তির স্বাভাবিক অনিবার্য প্রকাশ রূপে রূপায়িত করেছেন।

তারা প্রেমাকাঙ্ক্ষা যে সমাজ নিষিদ্ধতা তিনি জানেন কিন্তু প্রেমের দুর্বার শক্তির কাছ থেকে সমাজ তুচ্ছ। তাই তারার মনে অপরাধ বোধ থাকলেও তিনি প্রেমকে গোপনে রাখতে পারেনি। তারার সেই অপরাধ বোধ এই উক্তিতে প্রকাশিত হয়েছে—

“কি লজ্জা! কেমনে তুই, রে পোড়া লেখনি,

লিখিলি এ পাপ কথা,--হায় রে, কেমনে?”

নিজের প্রতি ধিক্কার বোধ জাগ্রত হলেও চিঠির মধ্যে তারা নিজের প্রেমাকাঙ্ক্ষা গোপন রাখতে পারেনি। প্রেমাবেগের প্রবল স্রোতে ভেসে গিয়েছেন—

“এস তবে, প্রাণসখে! তারানাথ তুমি;

জুড়াও তারার জ্বালা! নিজ রাজ্য ত্যজি,”

প্রেমের অসহনীয় জ্বালা তারার কথায় ব্যক্ত হয়ে উঠেছে—

“কে পারে লুকাতে কবে জ্বলন্ত পাবকে?

এস তবে প্রাণসখে! তারানাথ তুমি;”

অষ্টাদশ শতাব্দীর কোন কুলনারীর এই মনোভাব তার নারী সত্ত্বার মুক্তির কথায় ঘোষণা করে।

মধুসূদন কিভাবে কর্ম ভাবনার মধ্য দিয়ে প্রণয়ের সঞ্চার করেছে তার একটা মনোজ্ঞ সুন্দর চিত্র অঙ্কন করেছেন। সোমের গুরু গৃহে প্রথম আগমন কালেই তারার হৃদয়ে পূর্বরাগের সঞ্চার। তারপর থেকেই তারা সোমের প্রাত্যহিক প্রতিটি কর্মটি কর্মের সময় তার দেহ সৌন্দর্য পান করতেন। প্রকৃত পক্ষে প্রথম দিন থেকেই দেহ-মন-প্রাস সব কিছুই তিনি মনে মনে সোমের পাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। সেই দিন থেকে তিনি সযত্নে নিজের কেশ পরিচর্যা করতেন। পুষ্প রাশিকে কুন্তল রূপে পরিধান করতেন। প্রেমাকুল হয়ে বনদেবীর কাছে কাঁচলি, কঙ্কণ, মুক্তাহার, কিঙ্কিণী প্রার্থনা করতেন। কারণ এই সব দিয়ে তিনি তার যৌবন-বন-ঋতুরাজ সোমদেবকে খুশি করতে চান। সোমের বিদ্যা অধ্যয়ন কালে তারা আড়ালে বসে তার সুধা পান করতেন। গুরুর আদেশে সোমকে যখন দূর বনভূমিতে গোচারণে যেতে হত তখন তারা সোমের বিরহে অহর্নিশ অশ্রুপাত করতেন। গুরুপত্নী তারাকে যখন সোমদেব পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করতেন তখন তারা নিজেকে মানিনী নায়িকা বলে কল্পনা করতেন। যেন প্রেমিক এসে তার মানভঞ্জন করছেন। তারা প্রত্যহ শয্যা ত্যাগ করে সোমদেবের জন্য পুষ্প চয়ন করে রাখতেন হরিতকীর পরিবর্তে শয়ন শয্যায় তাম্বূল রেখে দিতেন। কুশাসনের তলায় কুসুমের রাশি বিছিয়ে দিতেন। এইভাবে ধীরে ধীরে যে গোপন অবৈধ প্রেম গড়ে ওঠে তার চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। তখন তারা স্পষ্ট ভাবে আহ্বান জানিয়ে লেখেন—

“কর আসি কলঙ্কিনী কিঙ্করী তারারে,

তারানাথ! নাহি কাজ বৃথা কুলমানে।”

সে আরও বলেছে—

“এ নব যৌবন, বিধু, অর্পিব গোপনে

তোমায়,”

তারার মধ্যে যে প্রেমের বিকাশের চিত্র তা আপাত দৃষ্টিতে পাপ ও অপরাধ বলে মনে হয়, কিন্তু উদার দৃষ্টিতে দেখলে একে মেনে নিতে হয়। ঋষির তরুণ স্ত্রীর তরুণ হৃদয়ের কামনা চরিতার্থতা লাভের জন্য সমস্ত বৈধতার পথ ছেড়ে বক্র পথ নিয়েছে,--হয়তো ঋষির অবহেলার জন্য। এর মধ্য দিয়ে কবি নবযুগের নারীর অবদমিত কামনাকে উদঘাটন করতে চেয়েছেন, হয়ত কৌলীন্য প্রথার নিষ্পেষণে নিপীড়িত নারীর মনের কথাও শুনিয়েছেন। তারার মধ্যে যে প্রেম বিকাশের চিত্র পাওয়া যায় তার রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায় অভিশাপের’ দেবযানীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সেখানেও ধীরে ধীরে একিভাবে দেবযানীর হৃদয়ের প্রেম বিকশিত হয়েছিল দুজনই প্রেমের বলিষ্ঠ প্রকাশে অকুতোভয়, তবে তারা অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ঋষি পত্নী বেদ, প্রচলিত রীতিকে, সমাজ সংস্কারকে অস্বীকার করে দেশগত কামনায় উচ্ছ্বসিত তারাদেবী বীরাঙ্গনা হয়ে উঠেছে। মধুসূদনের এই প্রেম চিন্তাকে সেকালের অনেকেই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেননি। যোগিন্দ্রনাথ বসু বলেছেন—“তিনি যে কর্মে রুচির পরিচয় দিয়েছিলেন তার নিন্দা না করিয়া পারি না।” পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রকেও এধরণের ধিক্কার শুনতে হয়েছিল। অবৈধ প্রেম সমাজে নিন্দনীয় হতে পারে, কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে নিন্দনীয় নয়। ‘সোমের প্রতি তারা’ পত্রিকায় তাই এই প্রেম নিন্দনীয় না হয়ে সাহিত্য রসিকদের কাছে মধুসূদনের অসাধারণ কবিত্ব ও প্রেম ভাবনার অভিনবত্বের গুণে অভিনব হয়ে উঠেছে।