রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও কাব্যনাট্য
গীতিনাট্য :
রবীন্দ্রনাথ গীতিকবি হওয়ায় তাঁর রচিত কয়েকটি নাটকে গীতেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। এই জাতীয় নাটক তিনটি হল—বাল্মীকি-প্রতিভা (১৮৮১), কালমৃগয়া (১৮৮২) ও মায়ার খেলা (১৮৮৮)। দস্যু রত্নাকর কিভাবে দেবী সরস্বতীর বর লাভ করে আদিকবি হলেন, ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’য় তাই বর্ণিত। কবির মতে “ইহা সুরে নাটিকা অর্থাৎ সঙ্গীতই ইহার মধ্যে প্রাধান্য লাভ করে নাই, ইহার নাট্য-বিষয়টাকে সুর করিয়া অভিনয় করা হয় মাত্র।” ‘মায়ার খেলা’ সম্বন্ধে কবি লিখেছেন, “... মায়ার খেলা নাট্যের সূত্রে গানের মালা । ঘটনাস্রোতের পরে তাহা নির্ভর নহে, হৃদয়াবেগেই তাহার প্রধান উপকরণ।” এই নাট্যের কেন্দ্রীয় বক্তব্য—“সুখকামী প্রেমের পশ্চাতে যে-বাসনা আছে, তাহাই প্রেমকে নিরন্তর ব্যর্থতার মরীচিকায় কুটাইয়া মারে। দুঃখের তপস্যার মধ্য দিয়া বাসনাময় প্রেমকে যদি পরিশুদ্ধ করিয়া লওয়া যায়, তবেই মায়ার বন্ধন কাটাইয়া উঠিয়া প্রেমের মুক্ত স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।”
কাব্যনাট্য :
রবীন্দ্রনাথের নাট্যকাব্য কাব্যনাট্যগুলির সংলাপ কাব্যধর্মী। এখানে চরিত্র দ্বন্দ্বের অভাব আছে, ভাব-দ্বন্দ্বই এখানে প্রধান। কোথাও আবার তত্ত্বও আভাসিত। রবীন্দ্রনাথের এই শ্রেণী নাটক হল—প্রকৃতির প্রতিশোধ (১৮৮৪), চিত্রাঙ্গদা (১৮৯১), বিদায় অভিশাপ (১৮৯৩), ‘কাহিনী’র অন্তর্গত গান্ধারীর আবেদন (১৮৯৭), সতী (১৮৯৭), নরকবাস (১৮৯৭), লক্ষ্মীর পরীক্ষা (১৮৯৭) এবং কর্ণ-কুন্তী সংবাদ (১৯০০)।
‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এ রবীন্দ্র-মানস ও রবীন্দ্র-জীবনদৃষ্টির প্রথম যথার্থ পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং এই উপলব্ধি তাঁর পরবর্তী জীবনের কাব্যে, নাটকে নানা ভঙ্গিতে বারবার প্রকাশিত হয়েছে। ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ সম্বন্ধে কবির উক্তি নাটকটির ভাব বস্তুকে প্রকাশ করেছে—“নাট্যকাব্যের নায়ক সন্ন্যাসী সমস্ত স্নেহবন্ধন ছিন্ন করিয়া প্রকৃতির উপরে জয়ী হইয়া একান্ত বিশুদ্ধভাবে অনন্তকে উপলব্ধি করিতে চাহিয়াছিল। অনন্ত যেন সবকিছুর বাহিরে। অবশেষে একটি বালিকা তাহাকে স্নেহপাশে বদ্ধ করিয়া অনন্তের ধ্যান হইতে সংসারের মধ্যে ফিরাইয়া আনে। যখন ফিরিয়া আসিল তখন সন্ন্যাসী ইহাই দেখিল—ক্ষুদ্রকে লইয়াই বৃহৎ, সীমাকে লইয়াই অসীম, প্রেমকে লইয়াই মুক্তি। প্রেমের আলো যখন পাই তখনি যেখানে চোখ মেলি সেখানেই দেখি সীমার মধ্যেও সীমা নাই।”
‘চিত্রাঙ্গদা’য় আখ্যান বস্তু মহাভারত থেকে গৃহীত। কবি সেই কাহিনীর ওপর নতুন কল্পনার আলোকপাত করেছেন। চিত্রাঙ্গদা রূপবতী ছিল না। কিন্তু অর্জুনকে সে রূপে ভোলাতে চাইল—মদনের কাছে সে কিছুদিনের জন্যে রূপবতী হবার বর চাইল। মদনের বরে রূপ-লাবণ্যবতী চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। কিন্তু এই ঋণ-করা রূপের জন্যে তার মনে গ্লানি জন্মায়–শেষ পর্যন্ত সে অর্জুনের কাছে স্বরূপে ধরা দিল। রূপ নয় প্রেমই দেয় এবং কাম্য—এই তত্ত্ব আলোচ্য নাটকের মর্মকথা।
দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচ ও দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীর প্রণয় ও বিদায়—এই বিষয় অবলম্বনে ‘বিদায়-অভিশাপ’ রচিত। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় দেবযানীর প্রণয় নিবেদন আশ্চর্য-সুন্দর কাব্যশ্রী লাভ করেছে।
‘গান্ধারীর আবেদন’-এ উগ্র স্বার্থপরতার সঙ্গে নিত্য মানবধর্মের সংঘাতে শেষ পর্যন্ত মানবধর্ম জয়লাভ করেছে। এই নাট্যকাব্যে ভাবই প্রধান। এর একমুখী চরিত্রগুলিতে (গান্ধারী, দুর্যোধন ও ভানুমতী) নাটকীয় দ্বন্দ্ব অনুপস্থিত। এই জাতীয় সংলাপমূলক রচনায় রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও নাট্যধর্মের সমন্বয় হয়েছে।