শাক্তপদাবলীর ভক্তের আকুতি পর্যায়ে রামপ্রসাদ সেনের অবদান
শাক্তপদাবলীর ভক্তের আকুতি পর্যায়ে রামপ্রসাদ সেনের অবদান
শাক্তপদাবলী শুধুমাত্র মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। এই পদাবলীর একদিকে যেমন জীবন ঘনিষ্ঠ সুরের বৈচিত্র্যের ও কবিত্বের স্পষ্ট মাধুর্য মণ্ডিত, অন্যদিকে তেমনি মাতৃরূপের মহিমা ব্যঞ্জনা ও ভক্তিভাবের উদ্বোধনে অনন্য। জগৎ জননীর স্নেহলাভের জন্য শক্তি সাধক কবিরা তাদের অন্তর্মোহিত আকুতি প্রকাশ করেছে নানা পদে। ভক্ত যখন তার আরাধ্য দেবতার উদ্দেশ্যে আকুতি প্রকাশ করেন তখন তার প্রার্থনার বস্তুও তার অন্তরকে উদ্ভাসিত করে তোলে। মঙ্গল সাহিত্যে যেখানে ভক্তের সঙ্গে দেবদেবীর সম্পর্ক আদান-প্রদানে বৈষ্ণব পদাবলী ভক্তি শুধু উপাস্যের সান্নিধ্য কামনা করে। তার লীলা অনুভব করে সন্তুষ্ট সেখানে শাক্ত কবিদের সঙ্গে জগৎ মাতৃকার সম্পর্ক সন্তান ও মায়ের মত। মায়ের প্রতি সন্তানের যেমন ভালোবাসা আকুতি অভিমানবোধ স্পষ্ট হয় তেমনি শাক্ত পদকর্তারাও জগৎ জননীকে মর্ত জননী দেখে তার প্রতি ভক্তি অভিমান জানিয়েছেন। সেই অভিমানেই সাংসারিক দুঃখ-কষ্টে কবি বলে ওঠেন—
“মাগো তারা ও শঙ্করী
কোন অবিচারে আমার ’পরে করলে দুঃখের ডিক্রিজারি।।”
অভিমান যখন চরম সীমায় পৌঁছায় তখন কবি প্রকাশ করেন—
“এবার কালী তোমায় খাবো
তুমি খাও, নয় আমি খাই, দু’টোর একটা করে যাব।”
উপাস্যদেবীর প্রতি শাক্ত ভক্ত পার্থিব সম্পদের জন্য লালায়িত নয়। শুধু সাংসারিক দুঃখের দাবানল থেকে মুক্তি পেতে চান তারা। তারা প্রার্থনা করেছেন মায়ের অভয়া পদ, যে পদে আশ্রয় পেলে সংসারের মায়াবন্ধন কেটে যায়। সংসারের দুঃখ জ্বালা থেকে রক্ষা না পেয়ে তবে কবির হৃদয় ব্যথিত হয়—
“ভবের গাছে বেঁধে দিয়ে মা পাক দিতেছ অবিরত।”
কিন্তু এই দুঃখ মায়ের লীলামাত্র তা কবিরা অনুভব করতে পেরেছেন। রামপ্রসাদ তাই বলে ওঠেন—
“ও মা কালী চিরকালই সঙ্ সাজলি এ সংসারে
এ সঙ্ সাজায় নাইকো মজা, সাজা পাই মা অন্তরে।”
তিনি আরও বলেন—
“প্রসাদ বলে, ব্রহ্মময়ী, বোঝা নামাও ক্ষণেক জিরাই।
দেখ সুখ পেয়ে লোক গর্ব করে আমি করি দুখের বড়াই।।”
তাইতো শেষ পর্যন্ত দুঃখের শেষে থাকে মায়ের অভয়া পদের প্রার্থনা, দাশরথি তাই বলেন—
“মনেরি বাসনা শ্যামা, শবাসনা শোন মা বলি।
অন্তিমকালে জিহ্বা যেন বলতে পায় মা কালী কালী।”
কালীর রূপান্তর দুর্গতিনাশিনী দুর্গাবতী। সেই দুর্গানাম ধ্যান করেন রামপ্রসাদ, যে নাম স্মরণ করলে মায়াবন্ধন কেটে যায়।
“দুর্গা দুর্গা দুর্গা বলে, তরে গেল পাপী কত ।
একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি,
দেখি শ্রীপদ মনের মতো ।।”
তাই কবির মনে আশা—
“এমন দিনকি হবে তারা,
যবে তারা তারা ব’লে, তারা বেয়ে পড়বে ধারা।।
হৃদি-পদ্ম উঠবে ফুটে, মনের আঁধার যাবে ছুটে,
তখন ধরাতলে পড়বো লুটে, তারা ব’লে হব সারা।।”
দেবীর শ্রীপদ ভক্ত কবিদের একমাত্র আরাধ্য বলে জীবনের দুঃখ-কষ্ট বোধের থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুলতা তাদের মধ্যে বেশি করে ফুটে উঠেছে। জীবন যন্ত্রণায় আবদ্ধ কবি শ্রীপদ না পেয়ে হতাশ সন্তানের মত অভিমানে গেয়ে ওঠে—
“কেবল আসার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হলো।
যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে র’লো।।
মা, নিম খাওয়ালে চিনি ব’লে কথায় করে ছলো।
ও মা মিঠার লোভে, তিত মুখে সারাদিনটা গেল।।”
তাই প্রেমানুভূতিতে পাগল কবি ভব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে উদাত্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন—
“আমার দে মা পাগল ক’রে (ব্রহ্মময়ী)
আর কাজ নাই জ্ঞান-বিচারে।।
তোমার প্রেমের সুরা, পানে কর মাতোয়ারা,
ও মা ভক্ত-চিত্তহরা, ডুবাও প্রেমসাগরে।।”
এইভাবে ভক্তের আকুতি পর্যায়ে কবিগণ মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা জানিয়েছেন নিজেদের ভব সাগর থেকে উদ্ধার করার জন্য। তাদের প্রার্থনা পার্থিব ঐশ্বর্যের নয়, সংসার থেকে মুক্তি। তাই পদগুলিতে সাংসারিক দুঃখ যন্ত্রণা বেশি করে ধরা পড়লেও পদগুলি কেবল দুঃখের আধার হয়ে ওঠেনি, মা ও সন্তানের বাৎসল্য রসের প্রকাশে অনন্য হয়ে উঠেছে।