‘নবান্ন’ নাটকের প্রধান সমাদ্দার চরিত্র
নাটক দৃশ্যকাব্য—মিশ্র শিল্প। নাট্যশরীরের প্রাণ হল তার চরিত্র সমূহ। তাই নাটকে চরিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। দর্শক এবং নাট্যকারের সংযোগ সেতু হল চরিত্র। নাটকে নাট্যকারকে থাকতে হয় পশ্চাতে আর চরিত্রগুলি নাট্যকারের বক্তব্যকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর সে কারণেই নাট্যকারের বোধ মনীষা, জীবনবোধ চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। চরিত্রের নিখুঁত শিল্পায়নে নাট্যকারের কৃতিত্ব সমধিক। একটা নাট্যকার বহুধা বিভক্ত হয়ে যান চরিত্রাবলীর মধ্য দিয়ে। নাট্যকারের চরিত্রের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক হয় বলে অনুকূলভাবে চরিত্র সৃষ্টির দিকে নজর দিতে হয়। আসলে চরিত্রকে বাস্তবানুগ এবং জীবনমুখী করে তোলার দায় দায়িত্ব সবকিছুই নাট্যকারের। তাছাড়া চরিত্রকে অসম্পূর্ণ না রেখে তাকে পরিপূর্ণতা বা সম্পূর্ণতা দানের কাজও নাট্যকারের।
অ্যারিস্টটল তাঁর নাট্যতত্ত্ব বিশ্লেষণে কাহিনির পরেই চরিত্রকে স্থান দিয়েছেন। উল্লেখিত বক্তব্যে একথা স্পষ্ট যে নাটকের ক্ষেত্রে চরিত্র একটি প্রধান অঙ্গ। ‘নবান্ন’ নাটকে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশটি চরিত্র বর্তমান। এই বিপুল চরিত্রমণ্ডলীর মধ্যে প্রতিটি চরিত্রের গুরুত্ব এবং স্থায়িত্বের দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে কিন্তু চরিত্রগুলর নাটকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করা চলে না। নট-নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য এ নাটকের চরিত্রগুলিকে যে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অঙ্কন করেছেন তাতে বিস্ময়াভূত হতে হয়।
অর্থলোলুপ আত্মসর্বস্ব ধনীবিলাসীদের কাছে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত অতিথি নিয়ন্ত্রণ বিধি নিতান্ত মূল্যহীন। একদিকে অর্থ ও ক্ষুধান্নের প্রয়োজনাতিরিক্ত অপরিমেয় অপচয় এবং অপব্যয়, আর অন্যদিকে অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের ব্যাকুল আর্তনাদ। উচ্ছিষ্টভোজী কুকুরের সঙ্গে আস্তাকুঁড়ে থেকে খাদ্যাংশ সংগ্রহের ব্যর্থ প্রয়াস আমিনপুরের নিরন্ন বৃদ্ধ কৃষক প্রধান সমাদ্দার, কুঞ্জ এবং রাধিকা এই দুর্গত শ্রেণির বাস্তব প্রতিনিধি রূপে নাটকে চিত্রিত হয়েছে।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অগ্যুৎময় উত্তেজনা, প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ সরকারের অকথ্য, অসহ, নির্মম ও বর্বরোচিত পুলিশি অত্যাচার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী ভয়ঙ্কর পরিণতি প্রসূত দুর্ভিক্ষ। অপরদিকে অকল্পনীয় প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের দুর্দম দাপটে ও সর্বগ্রাসী বন্যায় জলোচ্ছ্বাসে উড়িষ্যা এবং মেদিনীপুরের একাংশ ও চব্বিশ পরগণায় দেখা দেয় চরম আকারে অন্নাভাব।
এমনিভাবে একদিকে ব্রিটিশ সরকারের সংগ্রহনীতির রূপায়ন অন্যদিকে মনুষ্যত্বহীন মজুতদার, মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী নির্লজ্জ অর্থ লিপ্সার কারণে ১৯৪৩ সালে অবিস্মরণীয় পঞ্চাশের মন্বন্তর ও মহামারীতে গ্রামে-গঞ্জে-শহরে দেখা দিল অন্নের হাহাকার। আর চারিদিকে মৃতের স্তূপ। পুরুষানুক্রমে স্বগ্রামে পিতৃ-পিতামহের আবাসভূমিতে নিরাপদ জীবনযাত্রা নির্বাহী অবস্থাপন্ন ও সচ্ছল কৃষক পরিবার অন্নাভাবে অন্নসংস্থানের চেষ্টায় সেদিন কলকাতার পথে পথে জমায়েত হয়। খাদ্যের অভাবে মরণাপন্ন অগণিত জনগণের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে এক শ্রেণির হৃদয়হীন ধনী অসৎ ব্যবসায়ী দিনের পর দিন বিবেকহীন ভাবে অর্থ লোলুপতায় নিজেকে পুষ্ট করতে ব্যস্ত।
একদিন যার সবকিছু ছিল। ছিল একটি সুখী পরিবার, সুন্দর জীবন যা একজন গ্রাম্য মানুষের কাছে কাম্য তার সবকিছুই। কিন্তু আজ তার কোনকিছুই নেই। এমনকি দু’বেলা দু’মুঠো অন্নও জুটছে না। এই অন্নাভাবে জর্জরিত ‘নবান্নে’র অন্যান্যসকল চরিত্রের মতো প্রধান সমাদ্দারও। যে এ নাটকের নায়ক। আসলে এ নাটকে যদি কোন নায়ক থেকে থাকে সে প্রধান। কারণ ঘটনা ও চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাতে একমাত্র সেই নায়কের যোগ্য বলে মনে হয়।
নাটকের প্রথম দৃশ্যেই যখন সে আবির্ভূত হয়েছে তখন তাকে আমরা এক বৃদ্ধ রূপে দেখি। কিন্তু এই বৃদ্ধাবস্থায়ও তার মধ্যে একটি পুরুষোচিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ লক্ষ্য করা যায়। দাঙ্গা এবং ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রামের মানুষের যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তারই মুখে আমরা শুনেছি আগস্ট আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কথা। তার বৃদ্ধা স্ত্রী পঞ্চাননী। একদিন ছিল তার পুত্রদ্বয়, কিন্তু আজ আর নেই। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা পুত্রদ্বয় শ্রীপতি ও ভূপতিকে মৃত্যু মায়ের চিরন্তন আদুরে কোলে সযত্নে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। পুত্রশোক বুকে পাষাণবৎ জমে আছে। পুত্রশোক সত্বেও প্রধান হত্যা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আসলে এ মৃত্যুর পিছনে ছিল এক কূট চক্রান্ত। যার মূলে তৎকালীন অত্যাচারী কূটচক্রী ইংরেজ সরকার।
কেমন যেন এক লক্ষ্যভ্রষ্ট ধূমকেতুর মতো প্রধান তার গতিময় জীবন থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে। তার সামনে যেন কোন বেঁচে থাকার সৎ আলো ছিল না। পুত্রদ্বয়কে হারিয়েও নতুন করে প্রধান মনকে বাঁধতে চেয়েছিল। স্ত্রীকে পাশে রেখে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবে একথা তার মনকে দৃঢ় করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু তাতেও বাধা এলো ভাগ্যের চক্রাবর্তে। স্ত্রী পঞ্চাননীও মৃত্যুকে প্রিয় করে প্রধানকে একাকী রেখে গেল ফেলে। আবার ভাইপো কুঞ্জ ও কুঞ্জের ছেলে মাখনের মুখ দেখে স্ত্রী-পুত্রের দুঃখ ভুলতে চাইলেও প্রধানের কপালে সে সুখ সহ্য হয়নি। আকস্মিক সর্বনাশা ঝড় ও বন্যা সব আশা ভণ্ডুল করে দেয়। থার দুঃখকে আরো বাড়িয়ে দেয় হারু দত্তের মতো স্থানীয় পোদ্দারের আক্রমণ এবং মাখনের অকাল মৃত্যু।
এমনি করে একের পর এক মৃত্যু মিছিলের আক্রমণে প্রধান মানবিক ভারসাম্যকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। তাই দুর্ভিক্ষের দিনে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য দু’মুঠো অন্নের সন্ধানে গ্রামের পূর্বপুরুষের ভিটে ত্যাগ করে প্রধান পা বাড়ায় শহরের দিকে। শহুরেমুখী হতে তার মন এতটুকু সায় দিচ্ছিল না। তবুও পেটের জ্বালা তাকে বাধ্য করে।
গ্রামের চেনা সুর, মাটির গন্ধে ও স্পর্শে সতেজ প্রধান ইঁট-কাঠ-পাথরের শহরে উপনীত হয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ে। একদিন যে প্রধান ছিল লড়াকু প্রকৃতির সেই প্রধান আর তার লড়াকু মনোভাবকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এক বয়সের চাপে এবং অন্যদিকে অন্নাভাবে ক্লিষ্ট ও শোকাতুর প্রধান তার প্রাণোত্তেজনা হারিয়ে ফেলে। শহরের পথে পথে সে হত্যে হয়ে ঘুরেছে কেবল একটু ফ্যান কিংবা দু’মুঠো ভাতের জন্য। কিন্তু তার সকাতর প্রার্থনায় কেউ সাড়া দেয়নি। আসলে ক্ষুধা যে মানুষকে কতোটা পঙ্গু করে দেয়, ক্ষুধার জ্বালা যে কী বীভৎস হয়ে উঠতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিজন ভট্টাচার্যের এ নাটক। প্রধান চরিত্রের মধ্য দিয়ে তার উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে।
নাটকের পরিণতিতে গ্রামে ফিরে আসার পর প্রধান তার জীবন ফিরে পায়। তার মস্তিষ্কের অস্বাভাবিকতা স্বাভাবিকত্বের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে কুঞ্জ, দয়াল এদেরকে ছিনতে পারে এবং অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে চারপাশের বাস্তবতাকে ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করতে বলে—
“ভালো, ভালো, নবান্ন ভালো। সুদিন পড়েছে সব! দুঃখের দিন সব কেটে গেছে। কেটে গেছে সব দুঃখের দিন। আর আসবে না!”
প্রধান প্রচলিত অর্থে নায়ক না হলেও এ নাটকে Sufferings-এর কারণে সে হয়ে উঠেছে মুখ্য চরিত্র। গ্রামের শীর্ষ স্থানীয় মানুষ হিসাবে প্রধানকে সবাই মান্য করেছে। কিন্তু তার মহিমাসন থেকে পতিত হলেও এ নাটকের অন্য সকল চরিত্র থেকে সে একটু স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্যতার মহিমায় প্রধান নাটকের মুখ্য চরিত্রের আসন লাভ করেছে।