নারী চরিত্র সৃষ্টিতে মুকুন্দ চক্রবর্তীর অবদান || ফুল্লরা চরিত্র ।। আখেটিক খণ্ডের প্রধান নারী ফুল্লরা
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কালগত সীমাকে অতিক্রম করে মুকুন্দ সৃষ্ট ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যটি চিরকালীন আবেদনে উজ্জ্বল। নিপুন মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান এবং নিগূঢ় বাস্তবতা মিশ্রিত হয়ে তাঁর কাব্যেরর চরিত্রগুলি হয়ে উঠেছে সজীব বা জীবন্ত। তিণি স্ফূটনোন্মুখ মানবতার প্রথম কবি যখন আধুনিক কাল আনাগত, যখন মানুষ হিসাবে মর্যাদা অনাবিষ্কৃত, মুকুন্দরাম সেই কালের কবি। তাঁর কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’। এ কাব্যের চরিত্রগুলির মধ্যে কবি বাস্তবতার জীবন্দ চিত্র অঙ্কনে সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁর এ কাব্যের আখেটিক খণ্ডের একমাত্র নারী চরিত্র ফুল্লরা এবং অপ্রধান নারীচরিত্রগুলি হোল মুরারি শীলের পত্নী বান্যানী, নিদয়া, হীরাবতী, বিমলার মা। আমরা প্রথমে ফুল্লরা চরিত্রটি আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে পারি।
দেবী চণ্ডিকা আর ফুল্লরার কথোপকথনে ফুল্লরা গ্রাম বাংলার অতিপরিচিত গৃহবধূ রূপে ফুটে উঠেছে। দেবী পার্বতী মর্ত্যে পূজা পাবার জন্য ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে কালকেতুর রূপে মর্ত্যে পাঠিয়েছে। কালকেতু ব্যাধ সম্ভান, পশুশিকার ও মাংস বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়। তার অত্যাচারে বনের পশুরা ক্রন্দনমুখর। পশুগণ দেবীর কাছে তাদের দুঃখ বণর্না করলে দেবী তাদের অভয় দেন এবং কালকেতুকে কর্মে বিরত হতে বাধার সৃষ্টি করেন। সুবর্ণ গোধিকা রূপ ধারণ করে দেবী কালকেতুর যাতায়াত পথে পড়ে রইলেন। কালকেতু গোধিকাকে বাড়িতে এনে রেখে আবার হাটে চলল। ফুল্লরাও বাড়িতে ছিলনা। সখীদের বাড়িতে চাল ধার করতে গেছে। ঘরে কেউ নেই। সেই অবসরে গোধিকা রূপ ত্যাগ করে দেবী চণ্ডিকা ষোড়শী রমণীর রূপ ধারণ করলেন—
হুঙ্কারে ছিণ্ডিয়া দড়ি পরিয়া পাটের শাড়ি
ষোল বৎসরের হৈল বামা।।
ফুল্লরা গৃহে এসে ষোড়শী রমণীকে দেখে তার পরিচয় জানতে চায়। দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় দেবী উত্তর দিলেন। ফুল্লরা সব কিছু বুঝতে না পেরে বুঝল, ইনি ব্রাক্ষ্মণকন্যা ঘোষাল বংশে জন্ম, শ্বশুরকুল বন্দ্যবংশ, ঘরে সাত-সতীন, ইনি ফুল্লরার গৃহে আশ্রয় চান। ফুল্লরার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। হৃদয়ে বিষ মুখে মধু নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে লাগল, এবং জানতে চাইল কি কারণে স্বামী গৃহ ত্যাগ করে এমনভাবে একলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন—
শাশুড়ী ননদ কিবা কৈল মন্দ
স্বরূপ বল বাণী।
তোর বিরহ জ্বরে স্বামী যদি মরে
কোন্ ঘাটে খাবে পানী।।
ছদ্মবেশিনী দেবীর কথায় ফুল্লরা জানল— স্বামী জন্ম ভিখারী গঙ্গা নামে সতীন সর্বক্ষণ স্বামীর মাথায় চড়ে আছেন। সে স্বামী সোহাগিনী। পতির দোষ দেখে তিনি ঘর ছেড়েছেন— স্বামী বিষকণ্ঠী, পঞ্চমুখে গালিদেয়। সতীনের জ্বালা তো রয়েছে।
ফুল্লরার গৃহে রমণীর থাকার আগ্রহ দেখে ফুল্লরা তাকে উপদেশ দিতে শুরু করল । স্বামীই যে পরমগুরু, তাকে সন্তুষ্টি করাই নারীর ধর্ম—এই কথা রমণী অর্থাৎ দেবী চণ্ডীকে বোঝাতে লাগলো, সতিন ঝগড়া করলেও স্বামী ছেড়ে সে কেন এল?—
সতিনী কোন্দল করে দ্বিগুণ বলিবে তারে
অভিমানে ঘরছাড় কেনি।
যদি কর বিষপান আপনি ত্যজিবে প্রাণ
সতিনের কিবা হবে হানি।।
ফুল্লরার একথা শুনে দেবী কোনও উত্তর দিল না। তাঁকে চুপ থাকতে দেখে ফুল্লরা পুরাণকাহিনির বর্ণনা দিতে থাকল, স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তিতে উদ্দীপনা সৃষ্টিতে তৎপর হল। সে মুনিদের কাহিনি অবলম্বনে উপদেশ দিতে থাকল—
ভালে ভালে গৃহে লড় ভুলিয়া ভবন ছাড়
পতি লয়্যা কর গিয়া বাস।
দেবী বলেছেন—আমি একাকি কাননে বসেছিলাম। তোমার স্বামী ধনুকের ছিলায় আমাকে বেঁধে এনেছে। ফুল্লরা তখন ভাবল এ রমণীর গতি ভালো ঠেকছে না। অভাব অনটনের প্রসঙ্গ তুলছে রমণীকে বিতাড়িত করার জন্য—
কিরাত পাড়াতে বসি না মেলে উধার।
হেন বন্ধুজন নাহি যেবা সহে ভার।।
এছাড়া নিদারুণ অবস্থার বর্ণনা দিয়েছে যাতে করে রমণী পালায়—
“শুন মোর বাণী রামা শুন মোর বাণী।
কোন সুখে মোর সাথে হইবে ব্যাধিনী।।"
স্বামী যে পরমধন একথা বলেও ফুল্লরা দেবীকে ফেরাতে পারেনি। তাই দেবীর প্রতি তার উপদেশ সতীন-ভয়ে ব্যক্ত হয়েছে—
স্বামী বনিতার সে বিধাতা।
স্বামী যে পরম ধন স্বামী বিনে অন্যজন
কেহ নহে সুখ মোক্ষদাতা।।
ফুল্লরা এবার জোড় হাত করে উষ্ণ কণ্ঠে শেষ বারের মতো বলে—
কুবুদ্ধি লাগিল তোকে ঠেকিলি বিষম পাকে
কি কারণে আইলি তুই হেতা।।
ফুল্লরা ও দেবীর বাক্যালাপে প্রশ্নোত্তরে উপদেশ মূলক কথোপকথনে ফুল্লরার স্বামী-প্রণয়ের আভাস মেলে। মানবিক আবেদন কবি ফুটিয়ে তুলেছেন ফুল্লর মধ্য দিয়ে। তাই ফুল্লরা অকপটে বলতে পেরেছে—“স্বামী যে পরম ধন’। পুণংসহা ধরিত্রীর মতো রুখে দাঁড়িয়েছে সংসারে অন্যকারুর হস্তক্ষেপে। সত্যিই কবিকঙ্কন বাস্তব চরিত্র সৃষ্টিতে যে নিপুণ কৌশলী তা ফুল্লরাকে দেখে বোঝা যায় নারী ফুল্লরার প্রত্যেক কথায় প্রকাশ পেয়েছে সুলভ আচরণ। আর এমনি ভাবেই ফুল্লরা চরিত্রটি কবি কঙ্কনের লেখনীর দক্ষতায় অপরূপ রূপ নিয়ে পাঠকের দরবারে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে।