-->

রূপক নাটকে রবীন্দ্রনাথে অবদান

রবীন্দ্রনাথের রূপক-নাটক

ছোটগল্প বা উপন্যাস এবং কবিতার ন্যায় নাট্যসাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ প্রতিভার বৈচিত্র্য প্রকাশ করেছেন। নাটক-রচনার প্রচলিত রীতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে বহুবার গ্রহণ এবং ব্যবহার করেছেন। কিন্তু প্রচলিত নাট্যরীতির বাইরেও অনেক অভিনব নাট্যধারার তিনি প্রবর্তক। প্রথাবদ্ধ নাটকের সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কৌতুকনাট্য, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, রূপক প্রভৃতি রচনা করেন। প্রায় সর্বপ্রকার নাটকেই রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের সচেতন প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বহির্ঘটনার সংঘাত অপেক্ষা অন্তরের সুগভীর ভাবনা-দ্বন্দ্ব, তত্ত্বভাষ্য রবীন্দ্রনাথের নাটকে প্রাধান্য অর্জন করেছে। এই কারণেই সমালোচক টমসন রবীন্দ্রনাট্যকে vehicle of ideas বলেছেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি নাটকেই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব অনুভূতিবোধের প্রকাশ দেখা যায়। তিনি অন্যান্য নাট্যকাব্যের ন্যায় নাট্যকারসুলভ নির্লিপ্ততা বজায় রাখতে পারেননি। এই কারণেই তাঁর নাটক অভিনয়যোগ্য অপেক্ষা পাঠযোগ্য, অনুভবগম্য, সাহিত্যরস সমৃদ্ধ হয়েছে।

রূপক-সাংকেতিক নাটক :

উল্লিখিত তথ্য রবীন্দ্রনাথের রূপকনাটকগুলির প্রসঙ্গে প্রযোজ্য। প্রথাবদ্ধ নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, কৌতুকনাট্য ব্যতীত রবীন্দ্রনাথ এক বিশেষ ধরনের রূপকনাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন। শারদোৎসব’, ‘রাজা’, ‘অচলায়তন, ‘ডাকঘর’, ‘ফাল্গুনী’, ‘রক্তকরবী, ‘মুক্তধারা’, ‘কালের যাত্রাপ্রভৃতি রবীন্দ্রনাথের রূপক নাট্যরূপে পরিচিত। কোন কোন সমালোচক এগুলিকে রূপক নাটকনা বলে সাংকেতিক নাটকনামে অভিহিত করেছেন। কারণ তাঁদের মতে শারদোৎসবথেকে কালের যাত্রাপর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলি কোন বিশেষ জীবনদর্শন বা ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে এনেছে বলেই এগুলি সাংকেতিক নাটকরূপে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। কিন্তু এ বক্তব্য ঠিক নয় । কেননা, ‘শারদোৎসবথেকে কালের যাত্রা’—সব কটি নাটকের সমাপ্তিতেই নাট্যবিষয়ের তাৎপর্য সম্পূর্ণরূপে উপস্থিত হয়েছে, পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ লাভ করেছে, শুধুমাত্র ইঙ্গিত প্রদর্শন করেই ক্ষান্ত হয়নি। অর্থাৎ সাংকেতিক নাটকের রহস্যময়তা এইসব নাটকের মূল বিষয় নয়। যে অরূপ চৈতন্যকে কেন্দ্র করে নাটকগুলি রচিত সেই অরূপ চৈতন্য নাটকের মধ্যেই ক্রমশ স্বতঃপ্রকাশ হয়েছে, রহস্যের জাল ছিন্ন করে স্পষ্টতা অর্জন করেছে। সুতরাং এগুলিকে রূপক নাটক বলাই বিধেয়। উদ্দিষ্ট বিষয় বা বস্তুকে সরাসরি প্রকাশ না করে, গোপনে রেখে, অন্য কোন বিষয় বা বস্তুর বর্ণনার মাধ্যমে ক্রমশ তাকে রূপময় করে তোলা অর্থাৎ বিশ্লেষণ ও গ্রন্থিমোচনের সাহায্যে স্পষ্ট করে তোলাই হল রূপক নাটকের বৈশিষ্ট্য।জীবনের অনেক বক্তব্য, অনুভব-উপলব্ধি আছে যা প্রত্যক্ষত রূপায়িত করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথও এই কারণে তাঁর গভীর জীবন-বাণীকে এক-একটি নাট্যসংঘাতের মাধ্যমে অতি সন্তর্পণে উন্মোচিত করেছেন। তাঁর নাটকে সংকেত বা ইঙ্গিতময়তা যদি কিছু থাকেও, তবে তা রূপকেরই ব্যাখ্যার প্রয়োজনে এবং শেষ পর্যন্ত সংকেত-ই প্রধান হয়ে ওঠেনি। অবশ্য কেউ কেউ আলোচ্য নাটকগুলিতে সংকেত ও রূপকের সহাবস্থান লক্ষ্য করেছেন। নাম বা শ্রেণী জটিলতায় প্রবেশ না করেও এ কথা স্বীকার্য যে, ‘শারদোৎসবথেকে কালের যাত্রাপর্যন্ত নাটকগুলি প্রথানুগত নাটক নয় এবং এদের রসাবেদনও স্বতন্ত্র।

রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকের স্বরূপ :

রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলির রসাবেদন দৃষ্টিবাহী নয়, অনুভববেদ্য। প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যকাব্যহয়েও গভীর তাৎপর্যের মধ্যে এদের রূপমাধুরী নিহিত। তাই রূপক নাটকের তাৎপর্য অনুধাবন না করে শুধুমাত্র ঘটনা ও কাহিনীর ধারা অনুসরণ করলে এসব নাটকের বিশিষ্ট আবেদন লক্ষ্য করা সম্ভব হয় না। রূপক নাটকের তাৎপর্য হল রসসৌন্দর্য। রূপকাশ্রয়ী চরিত্র, পরিবেশ, ঘটনা প্রভৃতির ভিতর থেকে নাট্যকারের উদ্দিষ্ট বক্তব্য উদ্ধার করে নেওয়াতেই এ নাটকের প্রকৃত আনন্দ। অবশ্য প্রথাসিদ্ধ নাটকের মতই রূপক নাটকেও একটি আপাত-প্রচ্ছন্ন কাহিনী, কাহিনীর উত্থান-পতন, ক্লাইম্যাক্স, চরিত্র ও সংঘাত প্রভৃতি বজায় থাকে, কিন্তু তাদের পারম্পর্য, গতিবিধি এবং পরিণাম পরিচালিত হয় অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যের দ্বারা।

শারদোৎসব :

১৩১৫ সালে প্রকাশিত শারদোৎসবই রবীন্দ্রনাথের প্রথম রূপকনাট্য। এই নাটকে দেখা যায় যে, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা যখন শারদোৎসবের নাচে-গানে মুখর হয়ে উঠেছে, ‘নয়ন-ভুলানোর আগমনে সবাই আনন্দিত চিত্তে ঘোষণা করেছে, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালির মালা’—তখন কিশোর উপনন্দ প্রভুঋণ শোধের দুঃখময়-সাধনায় একাকী নিমগ্ন। শারদোৎসবে বহির্গত রাজা যেন এতক্ষণ এই দুঃখসাধক সাথীকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, কারণ তাঁর বিশ্বাস ঐ ছেলেটি দুঃখের সাধনা দিয়ে আনন্দের ঋণ শোধ করেছে, সেই দুঃখের রূপ মধুরতম। আত্মার প্রকাশ আনন্দময়, এই জন্যই সে দুঃখকে, মৃত্যুকে স্বীকার করতে পারে; ভয়ে, কিংবা আলস্যে, কিংবা সংশয়ে এই দুঃখের পথকে যে-লোক এড়িয়ে চলে, জগতে সে-ই আনন্দের থেকে বঞ্চিত হয়।

রাজা :

দুঃখের ভিতর দিয়ে আনন্দকে লাভ করার তত্ত্বটিই রাজা’ (১৩১৭) নাটকের বক্তব্য। রাজকুমারী সুদর্শনা আপন প্রাণের রাজাকে লাভ করার জন্যে রূপমুগ্ধ হয়ে অন্য রাজার গলায় মালা পরিয়ে দিল, সে ভুল করল। সেই ভুলের অন্তর্জালায় পরম দুঃখের মধ্যে নিমজ্জিত হল সুদর্শনা। এই মানসিক অশান্তির বা আঁধার-যাত্রার মাধ্যমেই ক্রমে তার মিলন হল আনন্দস্বরূপ রাজার সঙ্গে।

অচলায়তন :

অচলায়তন’ (১৩১৮) নাটকে প্রথানুগত্যের দৃঢ় প্রাচীর ভেঙে মুক্তিস্বরূপ আনন্দের দিকে যাত্রার জন্য মানবাত্মার সুতীব্র ব্যাকুলতা। অসার শাস্ত্রবাক্য সম্বল করে অচলায়তনের সকল শিক্ষার্থী যখন গুরুর সাক্ষাতের অপেক্ষায় রয়েছে, একমাত্র পঞ্চক-নামের কিশোরটি তখন প্রাচীর ভেঙে প্রথা বর্জন করে মুক্তির আস্বাদ লাভে ব্যগ্র। অবশেষে অস্পৃশ্য ঠাকুরদা দিলেন সেই প্রাচীর ভেঙে, দেখা গেল সেই ঠাকুরদাই প্রত্যাশিত গুরু। স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের সকল ভেদ ঘুচে গিয়ে মিলনের গান উঠল বেজে।

ডাকঘর :

মুক্তি-বাসনাই ব্যাপকতরভাবে ব্যক্ত হয়েছে ডাকঘর’ (১৩১৮) নাটকে। রোগজীর্ণ অমল, কবিরাজের নিষেধ গুরুজনের নির্দেশ অমান্য করে ঘরের বাইরে যেতে পারে না। অথচ বহির্জগতের আনন্দময় রূপময় লীলা তাকে প্রতিক্ষণে হাতছানি দিয়ে আহ্বান করে। প্রহরী বলে গেছে রাজার চিঠি আসবে তার কাছে, বাইরে যাবার উদার আহ্বান এসে পৌঁছবে। অপেক্ষায় থেকে অবশেষে মানবদেহের ক্ষুদ্র সীমা অতিক্রম করে অমল চলে গেল রাজার সান্নিধ্যে। সুদূরের পিয়াসী মানবাত্মার এক চির-মুক্তি-বাসনার ছবি ডাকঘরে রূপায়িত ।

ফাল্গুনী :

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুঞ্জয়ী জীবন-বিশ্বাস নিয়ে রচিত ফাল্গুনী’ (১৩২১) যেখানে আছে বসন্ত-রূপের অনন্ত উল্লাস। শুধু একটি ভাব, একটি বক্তব্যই এই নাটকের প্রাণকেন্দ্র, দৃশ্যত কোন কাহিনীও এ নাটকে নেই।

মুক্তধারা :

যন্ত্রশক্তি মানুষেরই আবিষ্কার হলেও যন্ত্র কখনো মানুষের চেয়ে বড় হতে পারে না, এ কথা প্রাণ দিয়ে জানিয়ে গেছে মুক্তধারা’(১৩২৮) নাটকের কিশোর নায়ক অভিজিৎ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “যন্ত্র দিয়ে যারা মানুষকে আঘাত করে তাদের একটা বিষম শোচনীয়তা আছেকেননা যে মনুষ্যত্বকে তারা মারে, সেই মনুষ্যত্ব-যে তাদের নিজের ভিতরকার মানুষকে মারছে।ধনঞ্জয় বৈরাগী ও অভিজিৎ সেই মনুষ্যত্বের চির অম্লান শক্তির প্রকাশ। এই নাটকটি রূপক হলেও প্রথাসিদ্ধ নাটকের মতো কাহিনী-চরিত্র এবং ঘটনা-নির্ভর।

রক্তকরবী :

রবীন্দ্রনাথের সর্বাপেক্ষা আলোচিত রূপক নাটক হল রক্তকরবী’ (১৩৩১)। রূপকের তাৎপর্য এবং নাটকীয় প্লট-বিন্যাসের সৌন্দর্যে রক্তকরবীই রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ নাট্যরচনা বলে অনেকে মনে করেন। প্রতাপের মধ্যে পূর্ণতা নেই, প্রেমের মধ্যেই পূর্ণতা”–এই সুগভীর জীবনদর্শন নাটকটির মর্মবাণী। আপন সমৃদ্ধি ও প্রতাপে তুষ্ট রাজা নিজের চারপাশে আত্মবিস্মৃতির জাল রচনা করে সম্পদের যক্ষপুরীতে বিরাজ করছিলেন। নন্দিনী এসে তাঁর মধ্যে প্রেমের আকুলতা জাগাল, রাজা আপন জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এসে বুঝলেন এতদিন প্রতাপকেই বড় করে মেনে প্রাণের আনন্দকে তিলে তিলে মেরেছেন, তাই তাঁর যুদ্ধ শুরু হল প্রতাপেরই বিরুদ্ধে। প্রেমের প্রবর্তনায় প্রাণের প্রবাহকে বাধামুক্ত করার চিত্রই হল রক্তকরবী

কালের যাত্রা :

কালের যাত্রা’য় (১৩৩৯) ঘোষিত হয়েছে প্রেমের শক্তি। আচার নয়, বিচার নয়, শুধুই প্রেম পারে মানুষকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করতে, মহাকালের রথ এগিয়ে চলে প্রেমেরই টানে।

রূপক নাট্যগুলির মূল্যায়ন :

আলোচিত রূপক নাটকগুলির প্রত্যেকটিতে কয়েকটি সাধারণ (common) লক্ষণ বর্তমান। নাটকগুলি তত্ত্বকেন্দ্রিক বলেই সংলাপনির্ভর। ঘটনা বা চরিত্রের ব্যক্তিগত অভিব্যক্তিতে যে কথা বলা যায় না, তাকেই মূর্ত করে তোলা হয়েছে ব্যঞ্জনাবহ সংলাপে আর সংলাপও যেখানে অপারগ, সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধ্বনিত হয়েছে সঙ্গীত। গানের মতো ভাব-প্রকাশক মাধ্যম আর কিছু নেই বলে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাট্যগুলি গীতিসমৃদ্ধ। প্রতিটি রূপকনাট্যেই গানের ভিতর দিয়ে মানুষের অন্তরশায়ী ভুবনকে দেখাতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। নাট্যকলা এবং রসাবেদনের বিচারে রবীন্দ্রনাথের রূপক নাটকগুলি বাংলা নাট্যসাহিত্যে নবধারার নাট্যরূপে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।