রবীন্দ্রনাথের মেঘদূত কালিদাসের মেঘদূতের নবভাষ্য
রবীন্দ্রনাথের মেঘদূত কালিদাসের মেঘদূতের নবভাষ্য:
কালিদাসের বিক্ষাত ‘দূতকাব্য’ মেঘের মুখে সন্দেশ বা বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে বলে এই কাব্যের অন্য নাম মেঘ সন্দেশ। পরবর্তী কালে মেঘদূতের অনুসরণে ধৈয়ীর ‘পবনদূত’ থেকে আরম্ভ করে রূপ গোস্বামীর ‘হংশদূত’, জম্বুর ‘চন্দ্রদূত’, কৃষ্ণসার্বভৌমের ‘পদাঙ্কদূত’, রুদ্রের ‘ভ্রমরদূত’, বজ্রনাথের ‘মনোদূত’ ইত্যাদি অজস্র দূতকাব্য ইত্যাদি অজস্র রচিত হয়েছিল। আধুনিক কালের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জ্যোষ্ঠের এক বর্ষণক্রান্ত বিকেলে শান্তিনিকেতনে মেঘদূত পাঠ করে ছিলেন এবং তার অনুভূতি উপলব্ধি, চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন মেঘদূত কবিতায়। কালীদাসের প্রতি তার কবিরূপ যেন শ্রদ্ধার্গ নিবেদিত হয়েছে এই কবিতায়। কালিদাসের কাব্যকেও অনুসরণ করলেও ভাবে-ভাষায়-আঙ্গিকে-ব্যঞ্জনায় এক নতুন সৃষ্টি হয়ে উঠেছে কবিতাটি।
কালিদাসের রচিত মেঘদূত এর দুটিভাগ –
ক) পূর্বমেঘ
খ) উত্তরমেঘ
পূর্বমেঘে বর্ণিত বিষয় হল – কুবেরের অনুচরের কর্তব্যের অবহেলার জন্য বিজন রামগিরি পর্বতে তার নির্বাসন এবং প্রিয়ার বিরহে কাতর যক্ষের মেঘকে দূত করে তার কাছে কুশল বার্তা প্রেরণের অভিপ্রায় এবং মেঘের যাত্রাপথের বিভিন্ন প্রাকৃতির দৃশ্য, জনপদ, জনজীবন, নদনদী ইত্যাদি বর্ণনা এবং সুরম্য অলকাপুরির বর্ণনা যেখানে যক্ষ প্রিয়ার রূপ লাবণ্যের কথা আর তার প্রেমিক প্রেরিত প্রেমের বার্তা ধ্বনিত হয়েছে। উত্তরমেঘে প্রকৃতি আছে কিন্তু তা নারীর দেহ সৌন্দর্যের উপকরণ হিসাবে। এবং কবি মনে করেছেন যক্ষ প্রিয়ার মত সৌন্দর্য প্রতিমা প্রভৃতি রাজ্যের মধ্যে কোথাও পাওয়া অসম্ভব। কাব্যখানি মন্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত।
কালিদাসের রোমান্টিক গীতি কাব্য মেঘদূত রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। মেঘদূতকে নিয়ে গদ্য ও পদ্য অসংখ্য সৃষ্টি রয়েছে। তিনি বলেছেন – “বন্দীহৃদয়ের বিশ্ব ভ্রমণ।” তিনিও মেঘকে দূত করে সুধুমাত্র ভ্রমণ করেননি, বিশ্ব ভ্রমণের আনন্দ উপলব্ধি করেছেন। আধুনিককালের মানুষ ধূসর প্রাচীন কালের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ স্থাপন করেছে। ‘প্রাচীন সাহিত্য’-এ তিনি লিখেছেন – ‘‘পূর্বমেঘে বহু বিচিত্রের সহিত সৌন্দর্যের পরিচয় এবং উত্তরমেঘে সেই এক এর সহিত আনন্দের সম্মিলন। পৃথিবীতে বহুর মধ্য দিয়া সেই সুখের যাত্রা এবং স্বর্গলোকে একের মধ্যে সেই অভিসারের পরিনাম।”
মেঘদূত কবিতার প্রথমেই দেখি কবি ভেবেছেন, কালিদাস কোন এক বিস্মৃত কালে আষাঢ়ের প্রথম দিনে তার কাব্যখানি রচনা করেছিলেন। মন্দাক্রান্তা ছন্দে বিশ্বের সমস্ত বিরহীদের হৃদয়ের বেদনাকে সঙ্গিতময় করে তুলেছিলেন বা সকল বিরহির বেদনাকে ভাষা দান করে মেঘদূত রচনা করেছিলেন –
“বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘন সংগীত-মাঝে পুঞ্জীভূত করে।”
সেদিন উজ্জয়িনীর প্রাসাদ চুড়ায় নাজানি কেমন মেঘের ঘনঘটা দেখা দিয়েছিল। বাতাস উদ্যাম, উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। মেঘের বুকে ধ্বনিত হয়েছিল গুরু গুরু রব। সেই মেঘের সংঘর্ষের মধ্যেই জেগে উঠেছিল মানবের চিরপুরাতন বিরহ বেদনা। সমস্ত কালের বন্ধন ছিন্ন করে কবি চিরদিনের বিরহের অশ্রু জলকে শ্লোকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। সেদিনের যতেক প্রবাসি জোড় হস্তে সমস্বরে মেঘের দিকে চেয়ে বিরহের গান গেয়েছিল। অশ্রুবাষ্প ভার তাদের প্রেমের বার্তা মেঘকে দূত করে পাঠাতে চেয়েছিল সুদূর দেশের ভূতল সায়িনী প্রিয়ার কাছে। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিকের হৃদয় বেদনাকে কবি কালিদাস যেন মেঘদূতে সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন।
‘মেঘদূত’-এর রচনার শত শত বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু প্রতিবছরের বর্ষা কাব্যখানিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে –
“প্রতি বর্ষা দিয়ে গেছে নবীন জীবন
তোমার কাব্যের’ পরে করি বরিষন
নববৃষ্টিবারিধারা, .....”
রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘদূত’-এর মধ্য দিয়ে বিরহকাতর প্রত্যেকটি মানুষের কণ্ঠস্বর সমুদ্রের কলোধ্বনির মত শুনতে পেয়েছে। কালিদাসের কাল থেকে রবীন্দ্রনাথ এরপরে জয়দেবের কালে প্রবেশ করেছে। তিনি বলেছেন এই রকম বর্ষার দিনে বাংলার জয়দেব হয়তো বিরহে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তিনি আকাশে অন্বেষণ করেছিলেন মেঘের –
“জয়দেব কবি আর-এক বর্ষাদিনে
দেখেছিলা দিগন্তের তমালবিপিনে
শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর।
আজি অন্ধকার দিবা, ....”
এমনই এক বর্ষণমুখরিত দিনে হয়ত পাঠ করেছিলেন একা গৃহ কোণে ‘মেঘদূত’। মেঘের সঙ্গে সহযাত্রী হয়ে তার হৃদয় উড়ে চলেছিল এক কাল থেকে অন্যকালে। মেঘের পিঠে চড়েই ‘মেঘদূত’-এর তথা প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে সানুমান আম্রকূট আছে, আছে রেবা বেত্রবতী নদী, জম্বুবনের ফল পেকে কাল হয়ে গেছে; কেতকীর বেড়া দিয়ে দশার্ণ গ্রাম রয়েছে। সেখানে তরু শাখায় বিহঙ্গিরা নীড় বাঁধতে ব্যাস্ত। তাদের কলরবে বনস্পতি মুখর। সেখানকার নারীরা ভ্রুবিলাস সেখেনি। তারা শুধু মেঘের দিকে চেয়ে আছে। এইভাব দৃশ্যের মধ্য দিয়ে তিনি অবন্তি উজ্জয়িনী ইত্যাদি জনপদে পৌঁছে গেছেন। সেখানে বিরহে অস্থির নারীরা বের হয়েছে প্রেম অভিশারে। বিদ্যুতের আলোয় তারা পথ চলেছে। এভাবেই কবি শিপ্রা উজ্জয়িনী তীরে নিজের দেখেছেন। ছায়াটি ধীরে ধীরে তার চোখে পরিষ্ফুট হয়েছে, আবার হরিয়ে গেছে।
মেঘের সঙ্গে কবি এই ভাবে পৌঁছে গিয়েছেন কামনার যক্ষধাম অলকাপুরিতে। সেখানে যেন রয়েছে – ‘সৌন্দর্যের আদি সৃষ্টি’ ‘বিরহীনি প্রিয়তমা’। তিনি যেন অনন্তকাল ধরে অনন্ত সৌন্দর্যের অলকাপুরিতে বসে রয়েছে। মেঘ ছাড়া অনন্ত সৌন্দর্য কেউ উপভোগ করতে পারতো না। -
“অনন্ত বসন্তে যেথা নিত্য পুষ্পবনে
নিত্য চন্দ্রালোকে, ইন্দ্রনীলশৈলমূলে
সুবর্ণসরোজফুল্ল সরোবরকূলে
মণিহর্ম্যে অসীম সম্পদে নিমগনা
কাঁদিতেছে একাকিনী বিরহবেদনা।”
কবি এই বিরহের স্বর্গলোকে পৌঁছেও আবার হারিয়ে ফেলেছেন সৌন্দর্যের জগৎ। মোহময় সেই স্বপ্নময়জগৎ থেকে বাস্তব জগতের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। সৌন্দর্যের বিচ্ছেদে তার মন হাহাকার করে উঠেছে–
“ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্রনয়ান,
কে দিয়েছে হেন শাপ, কেন ব্যবধান!
কেন প্রেম ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ!”
কবির মনে প্রশ্ন জেগেছে কেন প্রেম নিজের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। কিন্তু পরমুহূর্তে উত্তর খুঁজে পেয়েছেন তিনি যে ইন্দ্রিয় যুক্ত অবস্থায় স্থূল দেহে সৌন্দর্যের জগতে পৌঁছানো যায় না। কারণ সে জগৎ পার্থিব ইন্দ্রিয়ানুভূতির অতিত, তা শুধু প্রেমিক হৃদয়ের উপলব্ধির বিষয়। অনুভূতির বিষয় আর এজন্যই বাস্তব জগৎ থেকে কল্পনা জগতের মধ্যে অকল্পনীয় বিস্তর ব্যবধান রয়েছে।
প্রেম ও সৌন্দর্য বোধের সুগম সমন্যয়ে মেঘদূত কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার নতুন দীগন্ত উদ্ভাসিত করেছে। পূর্ববর্তি কবিতাগুলিতে প্রেম সমন্ধে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন এখানে তার চুড়ান্ত সফলতা সূচিত হয়েছে। নির্বাসিত যক্ষ নিখিল মানবের বিরহের প্রতীক। রামগিরি পর্বত ক্লেদ ও পঙ্কিলতা পরিপূর্ণ বাস্তবের কর্ম জগৎ। সৌন্দর্যপক্ষি বা অলকাপূরি আসলে চিরন্তন সৌনন্দর্য জগৎ। যা থেকে আধুনিক কালের মানুষ বিচ্ছুত। মোহিতলাল মজুমদার বলেছে – ‘কালিদাসকে নতুন করিয়া আবিষ্কার ‘মেঘদূত’-এর কবি কল্পনাকে কাল ও দেশের বন্ধন মুক্ত করিয়া সর্বকালের মানব মনের ‘মানসী সরসী তীরে’ রবিহীন মণিদীপ্ত প্রদেশের দেশের অন্তরহীন অতৃপ্তির সৌন্দর্য তীর্থে প্রসারিত হইয়া দেখা এটাই হল কবিতার প্রধান কবিকীর্তি।’ একের বিরহ বহুতে প্রসারের মধ্য দিয়েই কালিদাসের মেঘদূত রবীন্দ্রনাথের কলমে নবভাষ্য হয়ে উঠেছে।