তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ে 'ধাত্রীদেবতা' উপন্যাসের শিবনাথ চরিত্র
শিবনাথ চরিত্র:
“ধাত্রীদেবতা’য়
জমিদারের ছেলে শিবনাথের শৈশব হইতে কৈশোর ও যৌবন পর্যন্ত পরিণতির কাহিনী বিবৃত
হইয়াছে।” এ মন্তব্যটি করেছিলেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ধাত্রীদেবতা
উপন্যাসটি যে তারাশঙ্করের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, সে বিষয়ে
কোনো সংশয় নেই। আর নায়ক শিবনাথের চরিত্রটি যে তারাশঙ্করের দ্বিতীয় সত্তা,
সে বিষয়ে স্বয়ং লেখক জানিয়েছেন, “এ
অভিজ্ঞতা আমার প্রত্যক্ষ। ছোট জমিদার বংশে আমার জন্ম—আবার কংগ্রেসকর্মী এবং আমার মা
দিয়েছিলেন এক বিচিত্র ন্যায় অন্যায় বোধের ধারণা;” ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে
নির্মিত এই চরিত্র শৈশব থেকে কারাগারে প্রবেশ পর্যন্ত প্রায়
অর্ধেক জীবনের চালচিত্রই এই উপন্যাস। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র শিবনাথের মননের বিস্তার, বিকাশ,
দহন, অনুভব প্রভৃতি এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয়
বিষয়।
উপন্যাসের সূচনাতে কিশোর শিবনাথের চরিত্রটিকে আলোকিত করে তুলে ধরা হয়েছে। তার
দুঃসাহসিক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা, নেকড়ে বাঘের
বাচ্চাকে পোষ মানানোর চেষ্টা, সারা রাত্রিব্যাপী ‘আনন্দমঠ’
পাঠের অভিজ্ঞতা, গৃহশিক্ষকের প্রভাব, গোঁসাই
বাবার কাছে মহাযুদ্ধের গল্প শোনা, জমিদার পুত্রের মতো ঘোড়ায়
চড়ার আগ্রহ—ইত্যাদি এই চরিত্রটিকে সাধারণ বালকদের চাইতে
একটা ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। পাশাপাশি গ্রামের মানুষের উন্নয়নের এবং কল্যাণের
জন্য দরিদ্র সেবা ভাণ্ডার স্থাপন করা এবং অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা করা তার মানব
কল্যাণকামী জীবন দর্শনকে উদ্বুদ্ধ করেছে। যেহেতু তখনও তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ
বিকাশ ঘটেনি, সেহেতু কখনো মা এবং কখনো পিসিমার দুই
বিপরীতমুখী প্রভাব শিবনাথকে দুই দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে। মা তাকে বলেছেন,
"বিলাসের শেষ নাই শিবু, যত বাড়াবে তত
বাড়বে, অথচ তৃপ্তি তোমার কখনো হবে না।"
পিসিমা তাকে মানুষ করে তুলতে চান প্রকৃত জমিদারের মতো। মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পিসিমা তাকে ঘোড়া কিনে
দিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন যৎসামান্য লেখাপড়া করে শিবনাথ পূর্বপুরুষদের
মতো কাছারিতে বসে জমিদারি পরিচালনা করুক। তিনি চেয়েছেন শিবনাথের মধ্যে একটা পৌরুষপূর্ণ ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে, যে ব্যক্তিত্ব এক হাতে শাসন করবে, অন্য
হাতে আশ্রয় দেবে। শিবনাথ যখন পিসিমাকে প্রশ্ন করেছে, "একা আমরা ক’জনের দুঃখ দূর
করব পিসিমা?" উত্তরে পিসিমা বলেছেন, "আমাদের বংশ আগাছার ঝাড় নয়। এ বংশ আমাদের শাল
গাছের জাত। যতক্ষণ খাঁড়া থাকবে একা একাই ছায়া দেবে, ডালে
পাতায় বহু পাখিকে আশ্রয় দেবে।" আনন্দমঠ পাঠ
করার পর মা বালক শিবনাথকে বলেছিলেন, "দেশ কি মাটি
শিবনাথ? দেশকে খুঁজতে হয় গ্রামের বসতির মধ্যে শহরের
মধ্যে।"
ম্যাট্রিক শেষ করে শিবনাথ রুশো, প্রুধো,
বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ মনীষীদের রচনাবলীর মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। ঘোড়ায় চড়তে তার আর ভালো লাগে না, কিন্তু
পিসিমা তাকে সুস্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেন, "তোমার সকালে
বিকালে কাছারিতে বসতে হবে কাল থেকে।" পরেরটি
হচ্ছে, "দুটি কথা মনে রেখো, কারো
কাছে মাথা নিচু করো না, পিতৃপুরুষের কীর্তি-বৃত্তি লোপ করো
না।"
কৈশোর অতিক্রম করে শিবনাথ যৌবনে উপনীত হয়। ক্রমশ তার জমিদারি সত্তার চাইতে
তার মানব কল্যাণকামী সত্তা প্রবল হয়ে ওঠে। সমগ্র বীরভূম জেলায় তখন অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ, কলেরা, মহামারী রূপে দেখা দিয়েছে। ঘরে ঘরে মানুষ মারা যাচ্ছে। শিবনাথ তার সহযোগী
বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বিপন্ন মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে। ততদিনে শিবনাথের
বিবাহ হয়েছে, কিশোরী স্ত্রীর সঙ্গে তার মানসিকতার ব্যবধান
ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। গৌরী তাকে পরামর্শ দেয় মহাযুদ্ধের বাজারে কয়লার ব্যবসায়
উদ্যোগী হতে। কিন্তু শিবনাথ সুস্পষ্টভাবে তাকে জানিয়েছে, এই
গ্রাম ছেড়ে জন্মভূমি পরিত্যাগ করে সে কোনো স্বর্গেও যেতে পারবে না। ব্যক্তি
স্বার্থের চাইতে তার কাছে বড় হয়ে ওঠে দেশ-দেশের মানুষ।
কলেরা আক্রান্ত জনৈক ডোমবধূর সেবা করতে গিয়ে শিবনাথের নাম যুক্তিহীনভাবে
জড়িয়ে পড়ে তার সঙ্গে এবং সমস্ত গ্রামে একটা মিথ্যা কলঙ্কের গল্প ছড়িয়ে পড়ে। গৌরী দূর থেকে এই মিথ্যা গল্পটিকে সত্য বলে ধরে নিয়ে স্বামীকে লিখেছে, "যে লোক একটা ঘৃণ্য অস্পৃশ্য ডোমের মেয়ের মোহে
আপনাকে হারাইয়া ফেলে, তাহার সহিত কোনো ভদ্র কন্যা, ভদ্র রমণীর বাস অসম্ভব।" এ সময় মর্মাহত শিবনাথকে কলকাতা থেকে সন্ত্রাসবাদী সুশীল আহ্বান জানিয়ে লিখেছে, "আপনি এখানে চলিয়া আসুন। গ্রাম ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া
দেশের বিশ্বরূপ দেখিতে পাইবেন।"
কলেজের ছাত্রজীবনে শিবনাথ জড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গে, কিন্তু কিছুদিন পরেই তার মনে হয় এটা স্বাধীনতা লাভের সঠিক পথ
নয়। সাঁওতাল পরগনার এক মহান বিপ্লবী তার দৃষ্টি খুলে
দেয়, "আমার ধারণা,
ইংরেজ তাড়ানোর নামই স্বাধীনতা নয়। ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ শূদ্রকে
অন্ধকার থেকে আলোয় আনতে না পারলে কখনো ভারতবর্ষের মুক্তি ঘটবে না। স্বাধীন ভারতের
শাসনভার চলে যাবে মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিত মানুষের হাতে। শূদ্রেরা পড়ে থাকবে সেই
অন্ধকারে।" ফলে শিবনাথ মায়ের
মৃত্যুর পর সন্ত্রাসবাদ পরিত্যাগ করে গান্ধীজীর গঠনমূলক দেশপ্রেমের মন্ত্রে এবং
অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘরের চাইতে বিশ্ব, সংসারের
চাইতে দেশমাতা তার কাছে বড় হয়ে ওঠে।
গৌরী তাকে মুক্তি দিয়েছে। সে মুক্তির মহিমাতেই সে মহামন্ত্র পাইয়াছে—বন্দে মাতরম্, ধরণীম্ ভরণীম্ মাতরম্। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক তরঙ্গ তাকে স্পর্শ করে। রাশিয়ার বিপ্লব, তুরস্কের আন্দোলন, ভারতবর্ষের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড তাকে উদ্বেলিত করে।
মা, পিসিমা এবং গৌরী—এই তিন নারী শিবনাথের জীবনকে তিন দিক থেকে প্রভাবিত করেছে। গৌরীকে সে বলেছিল, "মাঠে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মনে হলো মাটি যেন কথা কইছে।" কিন্তু এসব কথার মর্মার্থ গৌরী অনুভব করতে পারেনি। তবে গৃহশিক্ষক রামরতন বাবু তরুণ ছাত্রটির মানব কল্যাণমূলক কাজকর্ম দেখে উৎফুল্লিত প্রশংসা করে বলেছেন, "দিস ইজ রিয়েলি গ্রেট। আই অ্যাম প্রাউড অফ হিম।"
ময়ূরাক্ষীর তীরে
শিবনাথ নিজের হাতে কৃষিকর্ম করেছে। পৈত্রিক জমিদারি সে বিলিয়ে দিয়েছে প্রজাদের
মধ্যে। কারণ প্রুধোর মতো সে বিশ্বাস করে, "অতিরিক্ত সম্পত্তি হলো চোর্যবৃত্তির ফসল।" দাতব্য চিকিৎসালয়, নৈশ বিদ্যালয়,
তাঁত এবং খাদি ভাণ্ডার স্থাপন করে সে সাধারণ মানুষের পাশে এসে
দাঁড়িয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলিতে সে প্রকাশ্য
রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রামীণ মানুষদের উদ্দেশ্যে বলেছে, "সোনার দেশ শ্মশান হয়ে গেল, আজও কি মদ খেয়ে বিভোর হয়ে পড়ে থাকবার সময় আছে? বেরিয়ে
এসো দেশের কাজে স্বরাজের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো।"
কারাগারের অন্তরাল থেকে বন্দী শিবনাথ ধরিত্রী জননীকে প্রণাম জানিয়েছে পিসিমার মধ্য দিয়ে। "তুমি তো আমার বন্ধুকে চিনিয়েছ, তাতেই চিনেছি দেশকে। আশীর্বাদ করো, ধরিত্রীকে চিনে যেন তোমায় চেনা শেষ করতে পারি।" এইভাবে তারাশঙ্কর শিবনাথ চরিত্রে ক্রমবিকাশের এক মহৎ পথরেখা অঙ্কন করেছেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন


