-->

কবিকঙ্কণ মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মুরারি শীল চরিত্র

 

কবি মুকুন্দের ব্যাপক জীবনাভিজ্ঞতা এবং সুগভীর জীবনরস রসিকতা তার সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে দিয়েছে অসাধারণ দীপ্তি ও উজ্জ্বলতা। কবির জীবনাভিজ্ঞতা তাঁকে করে তুলেছে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারী, তাঁর জীবনরসিকতা তাঁকে করেছে চরিত্রসমূহের প্রতি সহানুভূতিশীল। ফলে তাঁর অঙ্কিত চরিত্রগুলি রক্ত মাংসের জীবন্ত স্বভাবের অধিকারী হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে লাভ করেছে উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য। কালকেতুর অঙ্গুরী বিক্রয়অংশে মুরারি শীল ও তস্য পত্নীর চরিত্র জীবন্ত রূপলাভ করেছে।

দেবী চণ্ডী পূজা প্রচারের জন্য ভক্ত কালকেতুকে একটি অঙ্গুরী ও সাতঘড়া ধন দিয়েছেন এবং সেই আংটি কালকেতু ভাঙাতে গেলে যাতে যথোচিত দাম পায় সেজন্য আগে থেকেই চণ্ডী মুরারিকে জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ধূর্ত বণিকের প্রধান মূলধন প্রতারণাবৃত্তি ও নাটকীয় ভঙ্গি। সে এ দুটিকে মূলধন করে ধূর্ততার বেসাতি যেভাবে করে গিয়েছে তাতে কবিকঙ্কণের লোকচরিত্রজ্ঞান যে কত প্রখর ছিল তা উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না।

বান্যা যে দুঃশীলতা কবি প্রথমেই চিত্রায়িত করেছেন। কেননা কালকেতুর খুড়া খুড়াডাক শুনেই মুরারি ঘরের মধ্যে আত্মগোপন করেছে। কারণ কালকেতুর কাছে মাংসের ধার আছে দেড়বুড়ি! মুরারি শীল প্রচুর অর্থের মালিক হওয়া সত্ত্বেও সামান্য দেড়বুড়ি ধার মেটাতে কুণ্ঠিত। কালকেতুর মতো দরিদ্র ব্যাধকে তার প্রাপ্য সামান্য অর্থ থেকে বঞ্চিত করতেও মুরারির বিবেকে বাধে না।

আবার বণিক মুরারি ভাগ্যবান বক্তি। সংসারে উপযুক্ত গৃহিণী পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু মুরারির ভাগ্য এ ব্যাপারে ঈর্ষণীয়। ধূর্ত লোকের যোগ্য ধূর্ত পত্নী। তাই মাংসের ধার শোধ করবে না বলেই অন্দরমহলে লুকিয়ে পড়ে অবস্থা সামাল দিতে নিজের স্ত্রীকে নিযুক্ত করেছে। চাতুর্যময়ী রমণী বাণ্যানী কৃপণ স্বামীকে পাওনাদারের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বের হয়ে এসেছে। কালকেতুকে সম্ভাষণ পূর্বক মুরারির উপযুক্ত সহধর্মিণীর মতোই মিথ্যা কথা বলেছে--

ঘরেতে নাহিক পোত্‌দার ।

প্রভাতে তোমার খুড়া        গিয়াছে খাতক পাড়া

কালি দিব মাংসের উধার ॥

কিন্তু এতেও সে আশঙ্কামুক্ত হতে পারেনি। পাছে কালকেতু অপেক্ষা করতে চায়, এই আশঙ্কায় তাকে অবিলম্বে বিতাড়িত করবার বাসনায় সে নূতন আদেশ জারি করেছে

আজি কালকেতু যাহ ঘর।

কাষ্ঠ আন্য একভার           একত্র শুধিব ধার

মিঠা কিছু আনিহ বদর ৷

কবিকঙ্কণের অসাধারণ মানবচরিত্রজ্ঞান না থাকলে বণিকপত্নীর এই চাতুর্য ও কপটতা তুলে ধরা যেত না। বণিকের সঙ্গে তার পত্নীর ধূর্ততার যে রাজযোটক মিল তা বলাবাহুল্য।

কিন্তু কালকেতু পূর্বের প্রাপ্য দেড় বুড়ির তাগাদায় আসেনি। অঙ্গুরী ভাঙ্গাবার জন্যই যে সে এসেছিল এবং বণিকের সাক্ষাৎ না পেয়ে বাধ্য হয়েই তাকে অন্য বণিকের বাড়ী যেতে হচ্ছে, তা জেনে সে প্রস্থানের উদ্যোগ করেছে। কালকেতুর এই উক্তি যেন যাদু সংঘটন করেছে। নিমেষের মধ্যে সমগ্র পরিস্থিতির নাটকীয় পটপরিবর্তন ঘটেছে। বণিকপত্নী স্বামীর আবির্ভাবের উপযুক্ত প্রেক্ষাপট রচনা করেছে

কালু দণ্ড দুই করহ বিলম্বন।

সরস করিয়া বাণী               হাসি কয় বাণ্যানী

দেখি বাপা অঙ্গুরী কেমন ৷৷

শিকার দেখে কালকেতুর যে আনন্দ হয়ে থাকে, ধনের আশ্বাস পেয়ে মুরারিরও সেরূপ আনন্দ হয়েছে। লোভ ও কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সে খিড়কী পথে কালকেতুর কাছে পৌঁচেছে। শুধু তাই নয়, কপট অনুযোগের মাধ্যমে কালকেতুর মন ভিজাতেও চেয়েছে বাণ্যা বলে ভাইপো ইবে নাহি দেখিতো এ তোর কেমন ব্যবহার।

সরল কালকেতু শঠ-শিরোমণি মুরারির সে অভিনয় ধরতে পারেনি। মুরারির অনুযোগকে সে সত্য বলেই মনে করেছে এবং যথোচিত আন্তরিকতার সঙ্গে উত্তর দিয়েছে। মুহূর্তমধ্যে মূল্য নিরুপণের ইচ্ছায় কালকেতুর অঙ্গুরী মুরারির হস্তগত হয়েছে।

অর্থলোলুপ, শঠ ও ধূর্ত মুরারি অঙ্গুরী পরীক্ষা করে যে রায় দিয়েছে তার মধ্যেও কবিকঙ্কণের মানবচরিত্রাভিজ্ঞতা লক্ষ্য করা যায়।

সোনা-রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল ।

ঘসিয়া মাজিয়া বাপু করেছ উজ্জ্বল৷

মুরারি যেন কালকেতুর প্রতারণা ধরে ফেলেছে, তার মত অভিজ্ঞ বণিকের দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া যেন অসম্ভব, এমনই একখানা ভাব দেখিয়েছে। প্রথম শ্রেণীর অভিনেতার মর্যাদা যে তার সংগতভাবেই প্রাপ্য তাতে কোন সন্দেহ নেইঅন্তত কবিকঙ্কণ সেই ভাবে তাকে এঁকেছেন। পিতল হিসাবেই কালকেতুর অঙ্গুরীর মূল্য নির্ধারণ করেছে মুরারি—

রতি প্রতি হইল বীর দশগণ্ডা দর।

দুই যে ধানের কড়ি পাঁচগণ্ডা ধর৷৷

অষ্টপণ পাঁচগণ্ডা অঙ্গুরীর কড়ি।

অঙ্গুরীর দাম নির্ধারণ করে তার সঙ্গে মাংসের দেড় বুড়ি ধার যোগ করে মোট যে দাম হয় সেই দাম সে দুভাবে দিতে চেয়েছে‘চালখুদ কিছু লহ কিছু লহ কড়ি।বণিকের ধূর্ততা যেন প্রতি পদে পদে। পূর্বরাত্রির দৈবাদেশ কে অগ্রাহ্য করে সে সাত কোটি টাকার অঙ্গুরীর মূল্যকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে অষ্টগণ আড়াই বুড়িতে, এ যেন রাতকে দিন করা। আধুনিক কালের পি সি সরকার যেন। সবচেয়ে আশ্চর্য হল এই যে, এমনতরো প্রতারণাকালেও ওষ্ঠপ্রাপ্ত মুরারি যে মৃদু ও স্নিগ্ধ হাসিটুকু প্রকাশ করেছে তা তার উচ্চতর অভিনয়-শক্তিরই পরিচায়ক। কবিকঙ্কণের মানবরস উপভোগ-ই এ ধরনের চরিত্রচিত্রণের মূলে কাজ করেছে।

কিন্তু মুরারি যাই বলুক না কেন, অঙ্গুরীটি দেবীপ্রদত্ত বলেই কালকেতুর মনে তার উচিত মূলা সম্বন্ধে সংশয় জেগেছে। কালকেতু অঙ্গুরী সহ অন্য বণিকের কাছে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে মুরারি পুরুষানুক্রমিক পরিচয়কে মূলধন করে পুনরায় ধূর্ততার প্রস্তুতি নিয়েছে

ধর্মকেতু ভায়া সনে কৈলুঁ লেনা-দেনা।

তাহা হইতে ভাইপো হয়াছ সেয়ানা ।

তাও ব্যর্থ হলে অঙ্গুরীটি নিয়ে হাত বদল করিতে বেণ্যার গেল মন। মুরারি যেন এখানে লোভ নামক রিপুটির জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে।

সহসা এমন সময়ে দৈববাণী হয়েছে। অন্যের অগোচরে দেবী মুরারিকে কালকেতুর উচিত প্রাপ্য মিটিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছে। মুরারি কিন্তু ঘটনার এই আকস্মিকতায় বিশেষ বিচলিত হয়নি। বরং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে তার ক্ষণপূর্বের কার্যকলাপকে সমর্থনযোগ্য করে তুলেছে

হৃদয়ে চিন্তিয়া বাণ্যা বলে মহাবীরে।

এতক্ষণ পরিহাস করিলাম তোমারে॥

উচিত মূল্য পেয়ে মহাবীর সাত কোটি টাকা নিয়ে বাড়ীতে এসে ব্যয়ের জন্য কিছু রেখে বাকি অংশ মাটির নীচে পুঁতে রেখে গোলাহাটে গমন করেছে। মুরারি শীল চরিত্রটিও কাব্য থেকে বিদায় নিয়েছে।

কিন্তু কবিকঙ্কণ যেভাবে বণিক ও তস্যপত্নীর সততা, অভিনয় দক্ষতা এবং ধূর্ততাকে মজবুত করার জন্য যে খোসামোদপূর্ণ ব্যবহার, বাপের নাম ব্যবহার করে বিশ্বস্ততা প্রমাণ করা, সোনাকে পিতল করতে গিয়ে ওষ্ঠপ্রান্তে হাসি দেখানো, ধরা পড়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া এবং হেরে গিয়ে জিতে যাওয়ার ভান করার মধ্যে জীবনাভিজ্ঞতা ও বস্তুনিষ্ঠার পরিচয় রেখেছেন। কবি মুকুন্দ চরিত্রটিকে রক্তমাংসের জীবন্ত স্বভাব দান করেছেন। সেজন্য কোন এক সমালোচক বলেছেন—

বাংলা সাহিত্যের বহু সুশীল চরিত্রই যেখানে অকালে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছে, সেখানে এই দুঃশীল বাণ্যাটি অনায়াসেই আত্মরক্ষা করিয়াছে। কাল তাহাকে হরণ করিতে পারে নাই, বরং সে-ই মহাকালের মনোহরণ করিয়াছে।”