-->

জীবনানন্দ দাসের ‘বোধ’ - বিশ্লেষণী পাঠ

জীবনানন্দ দাসের ‘বোধ’ -বিশ্লেষণী পাঠ

 জীবনানন্দ দাসের ‘বোধ’:

‘বোধ’ জীবনানন্দের কাব্যসৃষ্টির একটি অন্যতম ফসল। তাঁর কবিসত্তায় একধারে ধ্রুপদী ও রোমান্টিক চেতনা থাকলেও তিনি মূলত: রোমান্টিক কবি। রোমান্টিক চেতনা তাঁর সমস্ত কাব্যে পরিব্যাপ্ত। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কবির আত্মাবিষ্কারের কাব্য। এর অন্তর্গত ‘বোধ’ কবিতায় তিনি নিজেকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন।

            কবি আলো অথবা অন্ধকার—যেখানেই অবস্থান করুক না কেন, তার মাথার ভিতরে এক বোধ ক্রিয়াশীল অথবা ভালোবাসা অর্থাৎ মানবিক বোধসমূহ কিছুই কবির হৃদয়ে জন্মগ্রহণ করে না। কিন্তু যে বোধটি তাঁর হৃদয়ে জাগ্রত হয়, তাকে কবি কিছুতেই এড়াতে পারেন না। সেই বোধ কবিকে আবৃত করলে সমস্ত জগৎ তুচ্ছ মনে হয় ও অনন্ত শূন্যতা তাঁকে গ্রাস করে।

            এই পৃথিবীতে যারা সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করে তাদের পক্ষে জীবনের স্বাদ গ্রহণ সম্ভবপর হয় কিন্তু যার অন্তর্নিহিত অনুভূতির জগৎ-এ অনাদি বোধের উপস্থিতি ঘটে, তারপক্ষে সাধারণ জীবন-যাপন সম্ভবপর নয়। কবির ভিতরে শান্তি বা স্বপ্ন নয়, এক অনাদি-অনন্তবোধ ক্রিয়াশীল থাকে। কবি তাকে উপেক্ষা করতে চাইলেও সে তার অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করে। কবির স্বতঃই মনে হয়, তিনি যেন আপন স্বভাব-বৈশিষ্ট্যে এই বিস্তীর্ণ মানবসমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার আঁধারে নিক্ষিপ্ত হচ্ছেন।

            এই বিশাল বিশ্বপৃথিবীতে তাকিয়ে কবি মানবজীবনের মহামিছিল প্রত্যক্ষ করেন। কবি বোধের জগৎ থেকে বাস্তব জগতের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আত্মগত বিশ্লেষণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি প্রচলিত কর্মবদ্ধতা ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। কবি চাষির মত মৃত্তিকা ও জলের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে চান। যে নারী তাঁর ভালোবাসার, অবহেলার বা ঘৃণায় তাঁদের পরিত্যাগ করার মধ্যে কবির মর্ত্যপ্রীতি বিবৃত হয়েছে।

            কবি আপন হৃদয়কে জিজ্ঞাসা করেন—সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়? তার কি কোন অবসাদ নেই? এই বোধ পার্থিব জগতের মানব-মানবীর সঙ্গে পরিচিত নয়। বোধ পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ আকাঙ্ক্ষা করে না। এই বোধ সমস্ত সভ্যতায় এক বধিরতা ও বিনষ্টির ভাব আনে।

            জীবনানন্দের নিজস্ব কবিধর্ম এই কবিতায় প্রকাশিত। সাধারণ জীবন থেকে একটি স্বতন্ত্র সত্তা যে কবির থাকে—এখানে তার প্রকাশ ঘটেছে। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পর্যন্ত এসে কবির অনুভূতির জগৎ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর কাছে এক বিশেষ অনুভূতি হল বোধ। অনুভব যখন নির্দিষ্ট বিন্দুতে উপনীত হয়, তখনই তা বোধে পরিণত হয়। এই বোধের সত্য জীবনানন্দ একাই অনুভব করেন। ‘বোধ’ কবিতাতে অস্থির অনুসন্ধানী মনের চেহারা পাঠকের সামনে ধরা দিলেও সেই বস্তু যে কি—কবি তা স্পষ্টভাবে বলেননি। এক বিশেষ বোধের তাড়নায় কবি জীবন থেকে জীবনান্তরে ঘুরেছেন—

আলো-অন্ধকারে যাইমাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়শান্তি নয়ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;

আলোচ্য কবিতার প্রথম স্তবকে হৃদয়-বোধের তাড়নায় জর্জরিত কবি-মনে প্রার্থনার সময়টুকুও শূন্যতায় পর্যবসিত হচ্ছে। কবি তাঁর অন্তরের মানব-ধর্মের তাগিদে এক অদৃশ্য অবাধ্য বোধের দ্বারা তাড়িত হতে হতে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। কোন বিশেষ জীবনধর্ম হৃদয় বৃত্তি বা কর্ম প্রবৃত্তির কারণে এ বোধের জন্ম নয়। কবির এই বোধ এক অস্তিত্বের সংকট। ‘মহাপৃথিবী’ গ্রন্থের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতায় এই বোধের ব্যাখ্যার চেষ্টা দেখা যায়।

            নিজের মধ্যে কবি যে বোধের অনুভব করেছিলেন, তা তীব্রভাবে অনুভব করেন, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে এবং আরো বিশদভাবে ‘বোধ’ কবিতায়। এই বোধ যে স্পষ্ট চেতনা নয়, কবি সেই বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন আলোচ্য কবিতায়। মনের সংবেদন স্তরে জন্ম বলেই এই বোধ বুদ্ধির অগম্য। বোধ সমন্বিত মানুষ আপনাকে বুঝতে পারে না, অপরকেও বোঝাতে পারে না। এই তীব্র দুর্বোধ্য অস্বস্তি বহন করে সকল কবি-প্রাণেরই যাত্রা শুরু।

            জীবনানন্দের আলোচ্য কবিতায় অস্তিত্ববাদ ও আস্তিক্যবোধের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। ‘বোধ’ কবিতাটি সামগ্রিকভাবে হয় অস্তিত্ববাদী জীবনোপলব্ধির প্রকাশ নয়, তবুও এখানে জীবনানন্দের চেতনার স্তরকে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।