মধুসূদন দত্তের নাট্যকীর্তি: বাংলা নাটকের ইতিহাসে এক নতুন যুগ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত: বাংলা নাটকের আধুনিক যুগের পথিকৃৎ
মধুসূদন দত্ত ও
দীনবন্ধু মিত্র বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক বৎসর আগে-পরে আবির্ভূত হন। মধুসূদনের প্রথম
নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এবং দীনবন্ধুর প্রথম
নাটক ‘নীলদর্পণ’ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে
প্রকাশিত হয়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মৌলিক নাটক রচনার চেষ্টা চলছিল। যোগেন্দ্রনাথ
গুপ্ত, তারাচরণ শিকদার, রামনারায়ণ
তর্করত্ন, উমেশচন্দ্র মিত্র প্রমুখর লেখা নাটকগুলির মধ্যে
কিঞ্চিৎ বাস্তবতাবোধ এবং ইউরোপীয় নাট্যকলার অনুকৃতি লক্ষ্য করা যায়। তাঁদের রচিত
নাটকগুলির “প্লট সুকল্পিত নয়, এবং অধিকাংশই অসংলগ্ন, কতকগুলি দৃশ্যের সমষ্টিমাত্র।” ডক্টর সুকুমার সেনের
মতে, “শর্মিষ্ঠা’ বাংলা ভাষায় প্রথম
দস্তুরমত নাটক।” বাংলা নাটকের নতুন জীবন-দৃষ্টি ও নবীন আঙ্গিকের সার্থক সম্মিলন
ঘটেছে মধুসূদনের নাটকে। তার পূর্বে ধনী জমিদারদের শখের নাট্যমঞ্চে যে-সব নাটক
অভিনীত হত, সেগুলির নাট্যসৌন্দর্য কিছুই ছিল না। ১৮৫৮
খ্রিস্টাব্দে বেলগাছিয়ায় নাট্যশালার উদ্বোধন উপলক্ষে রামনারায়ণ তর্করত্নের সংস্কৃত
থেকে অনুদিত ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি
তর্জমা করবার সময় মধুসূদন বাংলা ভাষায় মৌলিক নাটকের দৈন্য অনুভব করেন এবং সেই অভাব
মেটাবার জন্য বাংলা নাটক রচনায় ব্রতী হন। ফলে যুগান্তকারী কবি মধুসূদনের হাতেই
বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। ইউরোপীয় নাট্যাদর্শ ও সুরুচি নিয়ে তিনি
বাঙালিকে ‘কুনাট্য’ দর্শনের দুর্ভাগ্য
থেকে রক্ষা করলেন। ফলে অনিশ্চিত পরীক্ষার উদ্দেশ্যহীন গতি থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলা
নাটক নিজস্ব স্বভাব-ধর্ম আবিষ্কার করল।
মধুসূদনের নাটকসমূহের পরিচয়:
‘শর্মিষ্ঠা’
(১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০)
ও ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১)-এই নাটক তিনটি
এবং দুটি প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) ও ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০) মধুকবির নাট্যকৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে। মধুসূদন বাংলা নাটকে
ইউরোপীয় নাট্যরীতির প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে তাঁর প্রথম দুটি নাটকে সংস্কৃত ও
ইউরাপীয় নাট্যকলার যুগ্ম অনুকৃতি লক্ষ্য করা যায়। সুপরিকল্পিত প্লট, নাটকীয় রসসৃষ্টি, অনুকূল ঘটনা বিন্যাস, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিকশিত চরিত্রগুলি ‘শর্মিষ্ঠা’
ও ‘পদ্মাবতী’ নাটক
দুটিকে অভিনব নাট্য-মর্যাদার অধিকারী করেছে। মহাভারতের যযাতি উপাখ্যান থেকে কাহিনী
আহরণ করে ‘শর্মিষ্ঠা’ রচিত হয়েছে।
উনিশ শতকের
নারী-মুক্তি আন্দোলনের সমর্থক মধুসূদন রাজকুমারী শর্মিষ্ঠার জীবনের দুঃসহ গ্লানি
মমতা-ভরা দৃষ্টিতে দেখেছেন। উনিশ শতকের বাঙালি জীবন-ধর্মের সার্থক ভাষ্যকার
মধুসূদন শর্মিষ্ঠাকে আদর্শ বাঙালি নারী রূপে চিত্রিত করেছেন। নাটকের
নারীচরিত্রগুলিতে বাঙালি নারীর চারিত্রিক মাধুর্য সঞ্চারিত হয়েছে।
পদ্মাবতী:
পরবর্তী নাটক ‘পদ্মাবতী’তে
ইউরোপীয় প্রভাব খুব বেশি আছে। ভারতীয় পৌরাণিক চরিত্রাবলীর ওপর গ্রীক পুরাণের
কাহিনীটি মধুসূদন কৌশলে প্রয়োগ করেছেন। গ্রীক পুরাণে ‘Apple of discord’ নামে যে-কাহিনী আছে, সেই কাহিনীটি তিনি শচী, রতি ও মুরজার জীবনে সন্নিবেশ করেছেন। প্যারিস এখানে ইন্দ্রনীল এবং হেলেন
পদ্মাবতীতে রূপান্তরিত হয়েছে। পূর্ব নাটক অপেক্ষা ভাষার সারল্যের জন্য এর নাটকীয়
সম্ভাবনা বেশি ছিল। তবে কল্পনার আতিশয্যে এবং অলৌকিকত্বের মাত্রাধিক্য সমাবেশের
ফলে ‘পদ্মাবতী’ তেমন সার্থক নাটক হয়ে
উঠতে পারেনি।
কৃষ্ণকুমারী:
মধুসূদনের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’ টড সংগৃহীত রাজপুতানার ঐতিহাসিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত। ডক্টর
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, "কৃষ্ণকুমারী-তে
মধুসূদন দৈবশাসিত, মায়াময় সুখ-দুঃখে ভরা, পৌরাণিক জগৎ হইতে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ, অমোঘ
কার্যকারণ-শৃঙ্খলায় গ্রন্থিত, দ্বন্দ্বময় রঙ্গভূমিতে নামিয়া
আসিয়াছেন।” শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডির আদর্শে রচিত এই ইতিহাস
ভিত্তিক নাটকটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি, বাংলা
সাহিত্যে গ্রীক নিয়তিবাদের প্রবেশও সর্বপ্রথম এই নাটকেই ঘটে। উদয়পুরের রাজা রানা ভীম
সিংহের কন্যা কৃষ্ণকুমারীকে বিবাহ করার জন্য দুই দেশের রাজা (জয়পুর রাজ জয়সিংহ ও
মরুদেশাধিপতি মানসিংহ) উদয়পুর আক্রমণে উদ্যত হলে দেশের কল্যাণের জন্য রাজকন্যা
প্রাণ বিসর্জন দিলেন। কৃষ্ণকুমারীর হৃদয়ের দ্বন্দ্ব নাটকে সার্থকভাবে পরিস্ফুট
হয়েছে। জয়পুররাজের রক্ষিতা বিলসবতীর চরিত্রটি যেন ক্ষণিকের ভুলে পদস্খলনের মধ্যে
নারী তার প্রাণসত্তাকে আবদ্ধ করে রাখার হৃদয়হীন অমানুষিকতার বিরুদ্ধে ‘মর্মস্পর্শী প্রতিবাদ’। এই নাটকের গদ্য-সংলাপ অনেকটা
সহজ হলেও দীর্ঘতায় ও কাব্যোচ্ছ্বাসে স্থানে স্থানে মেলোড্রামাটিক বা অতিনাটকীয় হয়ে
উঠেছে। কাহিনীর পরিকল্পনায় ও বিন্যাসে, নাটকীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব
ও গতিবেগের সৃষ্টিতে ‘কৃষ্ণকুমারী’ প্রথম
শ্রেণীর শিল্পকলা। গ্রীক-নাটকের প্রভাবে রচিত এই নাটকটি নানা বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর
বহনকারী বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি। সর্বপ্রথম
বাস্তব-কাহিনীহীন বাস্তব দৃষ্টি ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকেই লক্ষ্য করা যায়।
প্রহসন:
‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়
শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসন দুটিতেই মধুসূদনের নাট্য-প্রতিভার
চরম প্রকাশ ঘটেছে। দুটি প্রহসনের ভাষাই লঘুচপল অথচ সাবলীল ও জীবন্ত। আঙ্গিকের
উৎকর্ষ, রুচির শুচিতা ও সুষ্ঠু জীবনাদর্শের জন্য তৎকালীন
বাংলাদেশের সকল সুধীজন ও রসিক পণ্ডিত মধুসূদনের প্রহসন দুটিকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির
পর্যায়ে ধরেছেন। স্বাভাবিকতাকে বিকৃত না করে সমাজের কুশ্রীতাকে ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের
সাহায্যে এতটা স্পষ্ট করে তোলা এবং তার মধ্য দিয়ে কৌতূকরসের পরিবেশন করা খুব সহজ
কথা নয়। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’-য়
পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি অন্ধ আকর্ষণে বিভ্রান্ত যুবকদের উচ্ছৃঙ্খলতা সমষ্টিগত বলে
তাঁর কাছে কিছুটা ক্ষমা পেয়েছে। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ দলের কথ্যভাষার ‘ইঙ্গবঙ্গ’ রূপটি
অত্যন্ত সাবলীলতার সঙ্গে পরিস্ফুট করেছেন। যেমন- “বাঃ, তুমি
পাগল হলে না কি? যখন আমাদের সাবস্ক্রিপসন্ লিস্ট অতি পুয়র
ছিল, তখন আমরা নিজে থেকে টাকা দিয়ে সভাটি সেভ করেছিলাম...।”
বারাঙ্গনাদের মুখের ভাষা আরও সজীব ও প্রাণবন্ত। ‘বুড় শালিকের
ঘাড়ে রোঁ’তে প্রাচীনপন্থী ধর্মাভিমানী বিত্তবান বৃদ্ধ
জমিদারদের নারীদেহ-লোলুপতার প্রতি তীব্র কটাক্ষপাত করা হয়েছে। যশোহর জেলার
কথ্যভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগে ফতিমা, পুটি, হানিফ-প্রতিটি চরিত্র নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল ও সজীব হয়ে উঠেছে।
তৎকালীন প্রাচীন ও নবীন-উভয় দলই এই প্রহসন পড়ে বিরক্ত হন। ফলে মধুসূদন আর প্রহসন
লেখেননি।
মধুসূদনের নাট্যপ্রতিভার মূল্যায়ন:
মধুসূদন ছিলেন
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। শর্মিষ্ঠা নাটক রচনার মধ্যে দিয়েই মধুসূদনের বাংলা
সাহিত্য জগতে আবির্ভাব। তাঁর সাহিত্যরচনার সময়সীমা অত্যন্ত স্বল্পকাল-এর মধ্যেই
তিনি বাংলা নাটক ও প্রহসন রচনার কৃতিত্ব অর্জন করেন। মধুসূদন নাটক রচনা করেছিলেন
পুরাণ এবং ইতিহাসকে ভিত্তি করে। অবশ্য সমকালীন সমাজকে ব্যঙ্গ করার জন্যে যে দুটি
প্রহসন রচনা করেন তাতে তাঁর বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। উভয় ধারার রচনাতেই
মধুসূদন সাফল্যলাভ করেন। বাংলা কাব্যের মতো বাংলা নাটকেও মধুসূদন আধুনিক রীতির
প্রবর্তক।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন