-->

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসে সত্যচরণ চরিত্র

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসে সত্যচরণ চরিত্র
সত্যচরণ চরিত্র:

'আরণ্যক’ উপন্যাসখানির কাহিনী উত্তমপুরুষে বণিত। বর্ণনা যার মুখ দিয়ে করানাে হয়েছে, অর্থাৎ যে “আমি” উপন্যাসের সূত্রধর বা কথক, তার নাম সত্যচরণ—চাকুরিসূত্রে কলকাতা থেকে সমাগত জনৈক শিক্ষিত যুবক। সে-ই বাইরের তথাকথিত সভ্য জগতের সঙ্গে এই আরণ্য ভূখণ্ডের সংযােগ সাধনের একমাত্র সেতু। দুই জগতের মধ্যে যে অকথিত তুলনা উপন্যাসের প্রায় সর্বত্রই আত্মগােপন করে আছে, এই যুবকটির উপস্থিতি ব্যতিরেকে তা কিছুতেই সম্ভব হত না। তা ছাড়া উপন্যাসের গঠণশিল্পের দিক দিয়ে বিচার করলে তার আরও একটা ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করতে পারি। 'আরণ্যক'-এর মধ্যে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনার ও পরম্পর-বিচ্ছিন্ন চরিত্রের সমাবেশ করেছেন লেখক-সত্যচরণেব ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্যই তাদের মধ্যে একটা শিল্পসঙ্গত ঐক্য স্থাপন করেছে, গ্রন্থখানিকে একটা সুশৃঙ্খল ও সুসংহত শিল্পরূপ দান করেছে। চরিত্র হিসাবে তাকে নিতান্ত তুচ্ছ বা উপেক্ষণীয় বলে কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তথাপি তাকে ‘আরণ্যক'-এর নায়ক বললে মস্তবড় একটা ভুল করা হবে। সে বহিরাগত মানুষ-অরণ্যের সঙ্গে এবং অরণ্যচারী নর-নারীদেব সঙ্গে তার সত্যকার কোন নাড়ীর যােগ নেই। প্রকৃতির এই অরণ্য রঙ্গমঞ্চে প্রতিদিন যে রহস্যনাট্যে অভিনয় হয় তার বর্ণাঢ্য পট-পরিবর্তনের এবং বৈচিত্র্যময় ঘটনা-সংস্থানের সে নিষ্ক্রিয় দর্শক মাত্র। আগন্তুকের চক্ষু দিয়ে সে এই সৌন্দর্য ও মাধুর্যময় নাটকের অভিনয় দেখতে পারে মাত্র, তার অংশীভূত হয়ে যাবার, নিজে গিয়ে মঞ্চে উঠে দাঁড়াবাব সাধ্য তার নেই। সে সূত্ৰধার মাত্র বড়জোর তাকে এক দৃশ্যের সঙ্গে অপরাপর দৃশ্যের সংযােগ-রক্ষক বলা চলে।

বস্তুতঃ ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের কোন নায়ক নেই। নায়িকা স্বয়ং প্রকৃতি–অরণ্যেব রূপবৈচিত্র্যের এবং আরণ্যক নর-নারীর জীবন-বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে যার গােপন অন্তরাত্মা নিরন্তর আত্মপ্রকাশ করছে। সত্যচরণ দাঁড়িয়ে আছে সব কিছুর বাইরে। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সূক্ষ্ম অনুভূতির সাহায্যে সে যা দেখছে তা বুঝতে পারছে, উপভােগ করতে পারছে, কিন্তু কোন কিছুর সঙ্গেই ঠিক একাত্ম হতে পারছে না। কারণ সে অরণ্যের নয়, বাইরের মানুষ।

প্রথম সে যখন অরণ্য-ভূমিতে এসে পদার্পণ করে তখন সে পুরোপুরি শহরেরই মানুষ–কলকাতাকে ও কলকাতার সংস্কৃতিকে সে সযত্নে মনের মধ্যে বহন করে নিয়ে এসেছে, কলকাতা ছেড়ে চলে আসা তার পক্ষে নির্বাসনেরই সমতুল্য। সুতরাং অরণ্যের প্রতি ও আরণ্য সৌন্দর্যের প্রতি তার মন তখন উদাসীন ও অপ্রসন্ন, ঈষৎ বিদ্বিষ্টও বলা চলে। গােষ্ঠ গােমস্তা একটু হেসে ভবিষ্যদ্বাণী করে, “কিছুদিন এখানে থাকুন। তারপর দেখবেন।...জঙ্গল আপনাকে পেয়ে বসবে।”

ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়। ধীরে ধীরে সত্যচরণ অরণ্যের নেশায় বিভাের হয়ে ওঠে। অরণ্যের রঙ তার মনের গায়ে লাগতে থাকে; অরণ্য তার দুই চোখে এক অপূর্ব মােহাঞ্জন পরিয়ে দেয়; প্রকৃতির জারক-রসে সে একটু একটু করে জীর্ণ হয়ে যেতে থাকে। সুবিস্তীর্ণ বনভূমির বহুবিচিত্র রূপ ও বনবাসী মানুষের চারিত্রিক মাধুর্য ও অপরিসীম সরলতা তাকে মুগ্ধ কবে ফেলে। অরণ্যের প্রতি কিছুদিন আগেও যে ছিল একান্ত বৈরিভাবাপন্ন, সে-ই ক্রমে হয়ে দাঁড়ায় অরণ্য-বিলাসী, অরণ্য-প্রেমিক।

অরণ্য-প্রকৃতির প্রভাবে সে দেখতে শেখে কবির চোখ দিয়ে; অরণ্য-প্রকৃতি তার মনকে সংবেদনশীল কবিমনে পরিণত করে দেয়; অরণ্য-প্রকৃতি তার মুখে যােগায় কবির ভাষা। তাই তাকে বলতে শুনি, “কত রূপে কত সাজেই যে বন্যপ্রকৃতি আমার মুগ্ধ অনভ্যস্ত দৃষ্টির সম্মুখে আসিয়া আমায় ভুলাইল!--কত সন্ধ্যা আসিল অপূর্ব রক্তমেঘের মুকুট মাথায়, দুপুরের খরতর রৌদ্র আসিল উন্মাদিনী ভৈরবীর বেশে, গভীর নিশীথে জ্যোৎস্নাবরণী সুরসুন্দরীর সাজে হিমস্নিগ্ধ বনকুসুমের সুবাস মাখিয়া, আকাশভরা তারার মালা গলায়–অন্ধকার রজনীতে কালপুরুষের আগুনের খঙ্গ হাতে দিগ্বিদিক ব্যাপিয়া বিরাট কালীমূর্তিতে।”

কতবার ভেবেছে সে আর কলকাতায় ফিরবে না—এই উন্মুক্ত, স্বাধীন বন্য জীবনযাপনের পর আর সে সভ্যতার সােনার শিকল পরে দাঁড়ে বসে ছােলা খেতে পারবে না। স্বপ্ন দেখেছে, ভানুমতীকে বিয়ে করে নানা জীবজন্তু-অধ্যুষিত অরণ্যে পর্ণকুটির বেঁধে সুখের নীড় রচনা করবে, এই অরণ্যেই জীবন কাটিয়ে দেবে।

স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে, সফল হয় নি।বরং এই অরণ্য-প্রেমিক প্রকৃতির পূজারীর হাতেই স্বপ্ন-সৌন্দর্যময় অরণ্যভূমি ধ্বংস হয়েছে। কর্তব্যের দাবী, সভ্যতার অনিবার্য দাবী সে এড়াতে পারে নি; অরণ্যের মৃত্যুদণ্ড তার দ্বারাই ঘােষিত হয়েছে; এই স্বচ্ছ প্রকৃতির লীলাভূমি তার হাতের কুঠারেই বিনষ্ট হয়েছে। তাই তার স্মৃতি আনন্দের নয়, দুঃখের। তাই এতদিন পরেও অপরাধ-বােধের গ্লানির বােঝা সে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে নি। তাই বিদায়-বেলায় অরণ্যানীর পায়ের কাছে সে রেখে আসে অনুতপ্ত হৃদয়ের একটি প্রণাম : “হে অরণ্যানীর আদিম দেবতারা, ক্ষমা করিও আমায়। বিদায়!”

প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভােগ করে আনন্দ লাভের ক্ষমতা সকলের থাকে না—সত্যচরণের ছিল; সাধারণ মানুষ, দরিদ্র মানুষ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আরণ্যক মানুষ, এদের সঙ্গে প্রাণখুলে সবাই মিশতে পারে না—সত্যচরণ পারত; এই সব মানুষের সুখদুঃখে অংশীদার হওয়ার এবং তাদের সততায় ও সারল্যে মুগ্ধ হওয়ার শক্তি সবাই অর্জন করতে পারে না—সত্যচরণ পেরেছিল। তাই শিল্প-বিচারে একান্ত অবান্তর এই নেপথ্য-চারী মানুষটিকে আমরা ভালবাসি, না ভালােবেসে থাকতে পারি না—তার মধ্যে আমরা প্রকৃতি-পাগল বিভূতিভূষণের আত্ম-প্রক্ষেপ সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই।