জীবনানন্দের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতার বিষয়বস্তু
‘আট বছর আগের একদিন’
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য জীবনানন্দ সম্বন্ধে এক জায়গায় বলেছেন, “এ-জীবনের স্বাদ মানুষের বাস্তব জীবনে আজও আছে। ‘শত শতাব্দী’ আগের ‘সমুদ্র পারের কাহিনী’ ফাল্গুনের অন্ধকার কবির মনে এনে দিল তমিস্ত্র, ‘আট বছর আগের একদিন’ ফাল্গুনের রাতের আঁধারে একটি স্বাদু জীবন রক্তের পথে শেষ হয়ে গেল আত্মহত্যায়।”
কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাস তো জানেন যে জীবনে স্বাদ আছে, আনন্দ আছে। সুন্দরভাবে সংসার যাত্রা নির্বাহ করছে কত মানুষ স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে। প্রণয় ব্যর্থতাও তো আসেনি সকলের। কবি তাই ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় বলেছেন—
“শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোন
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু—আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে।”
সুতরাং জীবনে যে স্বাদ আছে তা অস্বীকার করার নয়। জীবনের স্বাদ গ্রহণের জন্যে আছে নারী হৃদয়, প্রেম, শিশু আরও কত জীবন-সম্ভোগের উপাদান
জীবনানন্দ সেই সঙ্গে এটাও জানেন যে, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, জীবনকে উপলব্ধি উপাদানসমূহ থাকলেও তৃপ্তি অন্য জিনিস—
“জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্তি করে
ক্লান্ত—ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই ;
তাই
লাস কাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।”
জীবনানন্দের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছেন, সৃষ্টিতেই ‘অসম্ভব বেদনার সাথে’ ‘অমোঘ আমোদ’ মিশে আছে। ‘আবহমান’ কবিতায় তিনি তা বলেছেন। ‘সিন্ধুসারস’ কবিতায় বলেছেন, বহুযুগের মানুষের গহন ক্ষতির বোঝা বহন করে এখনকার মানুষ আমরা ‘ক্লান্ত- আমরা বেদনার সন্তান।’ মানুষের অন্তর্নিহিত বেদনার কারণেই আত্মহত্যা করে মানুষ। মানুষের রক্তের ভিতরে যে বেদনা-বোধ, যে অতৃপ্তি, তাই তার মৃত্যুর কারণ হয়। এতো কবির কল্পনা নয়, এ জীবনের সত্য। কারণ জানা না গেলেও এরূপ ঘটনা ঘটেই চলেছে—সেই সংবাদই তো পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। কবিও ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় পেয়েছেন তেমনি সংবাদ—
“শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে।
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হলো তার সাধ;”
বধূর হৃদয়, প্রেম, শিশু, বিত্ত, কীর্তি জীবনের সমস্ত কিছুর মধ্যেও অবসাদ মৃত্যুর পথে নিয়ে যায় মানুষকে। কবি ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় বলেন—‘তবুও তো পেঁচা জাগে’—জ্ঞান তো ছেড়ে যায়নি মানুষকে। অবসাদের বিশেষ মুহূর্তে সেই জ্ঞানের নির্দেশ ভুলে যায় মানুষ, তখন সেই বিশেষ মুহূর্তে আত্মবিস্মৃত মানুষ—
“চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা ;
যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।”
এ-কবিতায় কবি শুধু বেঁচে থাকার আগ্রহের কথা বলেননি; জীবনের স্বাদের পরিচয় ও দিয়েছেন নানাভাবে। কেবল নারীর প্রেম-শিশু-বিত্ত-কীর্তিই নয়—
“জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের”
কিন্তু অবসাদ জীবনের এই বৈচিত্র্য তুচ্ছ করে দিয়েছে। কবির তাই জিজ্ঞাসা – জীবনের এই স্বাদ কি সহ্য করা গেল না—
“জীবনের এই স্বাদ—সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের—
তোমার অসহ্য বোধ হলো
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে—গুমোট
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্ত মাখা ঠোঁটে।”
কবিতাটিতে অবসাদের ফলশ্রুতিই বিশেষভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। আত্মহননেই যেন অনেকের পরম তৃপ্তি। সেই তৃপ্তির রূপটি এঁকেছেন কবি—
“লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাস কাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।”
জীবনের স্বাদ ও অবসাদকে জীবনানন্দ পাশাপাশি এঁকেছেন ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায়। স্বাদের মধ্যেও যেন কোথাও অবসাদ লুকিয়ে আছে। সংস্কৃতি আনে প্রশান্তি, রক্তে থাকে উন্মাদনা। এই উন্মাদনা যখন জীবনের স্বাদকে এড়িয়ে সাংস্কৃতিক জীবনকে ভোলে তখন রক্তের মধ্যে সঞ্চিত অতৃপ্তি জীবনের অবসাদ আনে, আত্মহননের উদ্বুদ্ধ করে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন