মহাকাব্যের সংজ্ঞা, মহাকাব্যের লক্ষণ, মহাকাব্যের শ্রেণিবিভাগ, বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক মহাকাব্য মেঘনাদবধের পর্যালোচনা
মহাকাব্য (Epic)
সংজ্ঞা :
মহাকাব্য হল বর্ণনাত্মক এমন তন্ময় কাব্য যার দৈর্ঘ্য, বিরাটত্ব, বিশালতা এবং ভাবগাম্ভীর্য যেমন রাজকীয় তেমন ছন্দও রাজকীয় ও স্থাপত্যধর্মী। মহাকাব্যে এক বিশেষ দেশের কথা বলা হলেও, তা সর্বদেশের সর্বকালের মানুষের জীবনাব্দ। J.A. Cuddon তাঁর ‘A Dictionary of literary terms and Theory গ্রন্থে মহাকাব্যের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘An cpic is a long narrative poem, on a grand scale, about the deeds of warriors and heroes. It is a polygonal, heroic story in corporating myth, legend, falk tale and history. Epics are often of national significance in the sence that they embody the history and aspirations of a nation in a lofty or grandiose manner.’ মহাকাব্যের চরিত্রগুলির চিন্তা ও কর্ম দেশ ও জাতির ভাবাদর্শের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকে। ভারতীয় আলঙ্কারিক বিশ্বনাথ মহাকাব্য পাঠে চতুর্বর্গ ফল প্রাপ্তির কথা বলেছেন। পাশ্চাত্ত্য কাব্যতত্ত্ববিদ অ্যারিস্টটল এমন কথা না বললেও মহাকাব্যকে ট্র্যাজেডির মতই গুরুগম্ভীর ঘটনার অনুকরণ বলে জানিয়েছেন।
মহাকাব্যের লক্ষণ
(১) গুরুগম্ভীর ঐতিহাসিক কিম্বা পৌরাণিক কাহিনি ও ঘটনা মহাকাব্যের বিষয়ে প্রাধান্য লাভ করে।
(২) অ্যারিস্টটল জানিয়েছেন ট্র্যাজেডির মতো মহাকাব্যেরও নানান প্রকারভেদ দেখা যায়। মহাকাব্য সরলও যেমন হতে পারে, জটিলও তেমন হতে পারে। ইলিয়াডের গঠন রীতি সরল, অপরদিকে ওডিসির গঠন রীতি জটিল।
(৩) বিশ্বনাথ জানিয়েছেন, মহাকাব্যকে নয় সর্গের কম হলে যেমন চলবে না, ত্রিশ সর্গের বেশি হলেও তেমন চলবে না। প্রত্যেক সর্গের শেষে পরবর্তী সর্গের সূচনার ইঙ্গিত থাকবে। সাধারণভাবে প্রত্যেক সর্গ একই ছন্দে রচিত হবে। চিরাচলিত প্রথা অনুযায়ী আশীর্বচন ও নমস্ক্রিয়া দিয়ে মহাকাব্য শুরু হবে।
(৪) মহাকাব্যের নায়ককে হতে হবে ধীরোদত্ত গুণসমন্বিত সৎবংশজাত বীর। তিনি দেবতা, কিম্বা রাজা, অথবা ওই পর্যায়ের এমন কেউ হবেন।
(৫) অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডিও মহাকাব্যের আলোচনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, মহাকাব্যের সবকটা অঙ্গ ট্র্যাজেডিতে থাকলেও, ট্র্যাজেডিতে সঙ্গীত থাকে মহাকাব্যে সঙ্গীত থাকে না, ট্র্যাজেডি মূলত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মূলক-অপরদিকে মহাকাব্য হয় বর্ণানাত্মক all the parts of an epic are included in tragedy, but those of tragedy are not of all them to be found in epic, অ্যারিস্টটল বলেছেন, মহাকাব্য হল বহুঘটনা সমন্বিত আদি-মধ্য- অন্ত্যযুক্ত এক অখণ্ড সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ার ফসল ।
(৬) মহাকাব্যের ভাষা হবে যেমন ওজস্বী তেমন হবে গাম্ভীর্যতাপূর্ণ।
(৭) বিশ্বনাথ কবিরাজ বলেছেন, শৃঙ্গার, বীর অথবা শান্তি এই তিনটি রসের যে কোনো একটি মহাকাব্যে প্রাধান্য লাভ করে এবং অন্য রসগুলি মূলরসের অঙ্গীরস হিসাবে বিরাজ করে।
(৮) নিসর্গ, প্রকৃতি, মানবিককর্ম মহাকাব্যের বর্ণনায় প্রাধান্য লাভ করে। মহাকাব্যের পটভূমি স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ব্যাপী বিস্তৃত থাকে।
(৯) সকল সমালোচকই বলেছেন মহাকাব্যের বিষয়কে ‘Serious’ হতে হবে এবং তা হবে ‘long narrative poem’- ‘It is a long narrative poem on a great and serious subject, related in an elevated style, and centered on a heroic or quasidivine figure on whose actions depends the fate of a tribe, a nation, or the human race."
(১০) লৌকিক-অলৌকিক অতিলৌকিক ঘটনা, দৈববিপর্যয়, যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র, প্রতিশোধস্পৃহা মহাকাব্যের বিষয়ে প্রাধান্য লাভ করে।
(১১) অ্যারিস্টটল বলেছেন, মহাকাব্যে আয়তন বৃদ্ধির যতখানি সুযোগ আছে, ট্র্যাজেডি নাটকে সেই সুযোগ নেই কারণ মহাকাব্য বর্ণনাত্মক কাব্য, অপরদিকে ট্র্যাজেডি নাটক হল দৃশ্যকাব্য।
মহাকাব্যের শ্রেণি বিভাগ
(১) Authentic Epic-
রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াডইলিয়াড, ওডিসি হল Authentic Epic। চিরকালের সমস্ত দেশ ও জাতির সৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সামগ্রিক রূপ এই সব মহাকাব্যে প্রত্যক্ষ করা যায়। গ্রীক জাতির ঐতিহ্যের সঙ্গে ইলিয়ডের ট্রোজানদের যুদ্ধ অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত থেকেছে, ‘ওডিসি’তেও সেই সূত্রেই রাজা ওডেসিয়াসকে যুদ্ধ সেরে স্বদেশে ফিরে আসতে দেখা যায়। ‘রামায়ণ’, ও ‘মহাভারতে ও সেই যুদ্ধ, বীরত্ব ও দেবদেবীর কাহিনি প্রাধান্য লাভ করেছে।
(২) Literary Epic -
Ennius এর ‘Annales’ ভার্জিলের ‘ইলিড’ (Aenied) Camoens এর Os Lusiadas’, Tasso ‘Gerusalemme Liberata’, Milton-এর ‘Paradise Lost’, কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’, ‘রঘুবংশ’, মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধকাব্য’ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বৃত্রসংহার’ এই শ্রেণির মহাকাব্যের অন্তর্ভুক্ত। অতীত কাহিনী এবং প্রাচীন মহাকাব্যের ধারা অনুসরণ করে সমকালের জাতীয় চিন্তা ও চেতনাকেই পরিস্ফুট করেছেন এই শ্রেণির মহাকবিতা। এই শ্রেণির কাব্যে ক্লাসিক কল্পনা সার্থকভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। এই শ্রেণির সর্বোৎকৃষ্ট epic হল মিল্টনের ‘Paradise Lost’ এবং মধুসূদনের "মেঘনাদবধ কাব্য’। ‘invocations, digressions, similes, legend, history, folklore, magic and the supernatural, eloquent speehes, perilious journeys, bottles and the sence of the underworld’, এই সব লক্ষণ দেখা গেছে Paradise Lost’-এ।
বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক মহাকাব্য
মধুসূদনের ক্লাসিক কল্পনা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে তাঁর সাহিত্যিক মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’। বীররস দিয়ে কাব্য শুরু হয়েছে। বীরবাহুর মৃত্যু সাধারণ মৃত্যু নয়—সম্মুখ সমরে পড়ি বীরচূড়াণি বীরবাহু। রাবণের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার শুধু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক নয়, রাজা প্রজার সম্পর্কও। প্রজা চিত্রাঙ্গদা রাজা রাবণকে সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এ কাব্যে বিলাপ শুধু চিত্রাঙ্গদা করেননি, বিলাপ করেছেন মন্দোদরীও। ক্লাসিক সাহিত্যিক মহাকাব্যের নায়কের যে সব গুণ ও অনুভূতি থাকে, সেইসব গুণ ও অনুভূতি প্রত্যক্ষ করা গেছে রাবণ ও ইন্দ্রজিৎ চরিত্রে। শ্রী তারাপদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যিক মহাকাব্যগুলির মধ্যে যে জাতীয় সুর (national Spirit) আছে, দেশ ও জাতি একটা অখণ্ড ভাবাদর্শ রূপে সে কাব্যের চরিত্রগুলির চিন্তা ও কর্মকে যেভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়াছে, ভারতীয় মহাকাব্যগুলির চরিত্রের মধ্যে সেরূপ জাতীয়-সচেতনতা দেখা যায় না। “ভারতীয় কবি মর্ত্যের মানুষের মধ্যে দেবদুর্লভ মহত্ত্ব-মহিমার বিকাশ দেখিয়েছেন কিন্তু যে কারণেই হউক জাতীয়তাবোধ তাঁহাদের মনন-কল্পনাকে কখনও অধিকার করে নাই । হয়তো ইহার কারণ ভারতীয় দৃষ্টির অখণ্ডতা, তাহা সকলকে এক করে না, বহুকে গ্রহণ করে না। জাতীয়তাবোধ আপনাকে সঙ্কোচ করে, তাই বিশ্ব মৈত্রীর বাণী যাঁহারা উচ্চারণ করিয়াছেন, অখণ্ড ভূমানন্দের স্বাদ যাঁহারা পাইয়াছেন, জাতীয়তা-মন্ত্রের খণ্ড আদর্শ তাঁহাদের ধ্যানে ও সাহিত্যে আসিতে পারে নাই।” অথচ এই National Spirit সাহিত্যিক মহাকাব্যের একটা বিশিষ্ট লক্ষণ এবং মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য সে বিশেষ লক্ষণে বিশেষিত। ‘মেঘনাদবধকাব্য’ দুহাজারেরও বেশি শ্লোক থেকে মহাকাব্যের গম্ভীর এবং উদাত্ত সুর ধ্বনিত হয়েছে।