রোমান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ
ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্য
ইউরোপের রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের যুগপুরুষ ছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। ইনি ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল ইংল্যান্ডের ক্যাম্বারল্যান্ডের একটি ছোট শহর ককারমাউথে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে এপ্রিল ৮০ বছর বয়সে মারা যান। দীর্ঘজীবনের অধিকারী ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রায় ৫০বছর কাব্যচর্চায় নিমগ্ন থেকে ইংরেজি সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থের নিরলস কাব্যচর্চার দিকে দৃষ্টি রেখেই বিস্মিত সমালোচকবৃন্দ মন্তব্য করেছিলেন— "Wordsworth is unique in the history of English poetry."
ওয়ার্ডসওয়ার্থ একদিকে ছিলেন প্রকৃতির কবি, ঐশীচেতনার কবি; অন্য ধারে তাঁর প্রকৃতিচেতনা একটা দার্শনিক প্রত্যয়ে পর্যবসিত হয়েছিল। ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই কর্মপ্রচেষ্টার দিকে নজর রেখেই সমালোচকরা তাঁকে প্রকৃতির মহাকবি ও দার্শনিক, The Highest Priest of Nature প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নব্য ক্লাসিক সাহিত্যের বিরুদ্ধে যে সমস্ত কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করে রোমান্টিকতার জয়গান গেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন এই উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি তাঁর কবিতায় প্রাধান্য পায় সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ এবং হাসি-কান্না, গ্রামীণ জীবনালেখ্য।
কৃষকের প্রাত্যহিক ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রথম কবিতা—‘অ্যান ইভেনিং ওয়াক'। এটি রচিত হয় ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। এই একই বছর ‘ডেসক্রিপটিভ স্কেচেস' নামের আর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটিতে ওয়ার্ডসওয়ার্থের আল্পস্ পর্বতের ভ্রমণকাহিনি এবং সুইজারল্যান্ডের কৃষকদের সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে।
১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও তাঁর বন্ধু কোলরিজের যুগ্ম সম্পাদনায় ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্' প্রকাশিত হলে বিশ্বসাহিত্যে রোমান্টিক যুগের সূচনা হয়। এখানে কোলরিজের চারটি ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের উনিশটি কবিতা স্থান পেয়েছে। কাব্যটি সেসময়কার কবি সাহিত্যিকদের দৃষ্টিভঙ্গীকেই পরিবর্তন করে দেয়। এর ভূমিকায় নতুন যুগের কাব্যের আদর্শ, স্বরূপ, ভাষা এবং আঙ্গিক কেমন হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্' ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবি জীবনের মাইলস্টোন হিসাবে গণ্য।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ১৭৯৯ থেকে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর আত্মজীবনীমূলক কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য প্রিলুউড’ রচনা করেন। এটি ওয়ার্ডসওয়ার্থের সৃষ্টিশীল সময়ের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এখানে মোট ১৪টি সর্গ আছে। দীর্ঘ ছয় বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় অতীত স্মৃতি রোমন্থনের এই কাব্যটিকে বলা হয়—'Memmory Recollect in Tranquility'. কাব্যটির মূল লক্ষ্য ছিল—'Self Examination and Self Expression' (আত্মসমীক্ষা ও আত্মবিশ্লেষণ)।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের আর একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল— ‘লুসি গ্রুপ অব পোয়েমস্'। ওয়ার্ডসওয়ার্থের সমগ্র কাব্যসম্ভারে প্রেমের কবিতার যে অভাব লক্ষ্য করা যায় তা কিছুটা পূর্ণ করেছে এই কাব্যটি। তবে এখানে তথাকথিত Passionate love (আবেগপ্রবণ ভালোবাসা) কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখানে প্রকৃতির সঙ্গে লুসি একাত্ম হয়ে গেছেন— যে প্রকৃতির মত সরল ও নিষ্পাপ। এই কাব্যে লুসির কোন সংলাপ নেই কেবল লুসিকে কেন্দ্র করে কবির আবেগ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয়েছে। লুসি বিষয়ক কবিতার সংখ্যা ছয়টি। এসব কবিতায় দেখানো হয়েছে লুসি প্রকৃতির প্রতীক এবং একই সঙ্গে বিশুদ্ধ প্রেমের প্রতীক। এক নির্জন কুটিরে একাকী সে বসবাস করে। প্রেমিক কবি অশ্বারোহণ করে সেখানে গিয়ে লুসির সাথে মিলিত হন। সমগ্র কাব্যে লুসির শারীরিক সৌন্দর্যের কোন বর্ণনা নেই। কবি চন্দ্রালোকে লুসিকে প্রত্যক্ষ করেন, আবার কালো মেঘে চাঁদের আলো নিভে গেলে লুসির মৃত্যুর আশঙ্কায় কবি ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। কোন কোন সমালোচক মনে করেন লুসির চরিত্রে ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্নায়বিক রোগগ্রস্ত বোন ডরোথির বাস্তব ছায়া প্রতিফলিত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনও বিতর্ক আছে।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি বিশিষ্ট চতুর্দশপদী কবিতার সংকলন ‘একলেসিয়াস্টিক্যাল সনেট'। এতে মোট ১৩২টি সনেট রয়েছে। এগুলির বিষয়বস্তু ধর্মীয় অনুভূতি ও দার্শনিক তত্ত্ব। অবশ্য সমগ্র জীবনে ওয়ার্ডসওয়ার্থ তিন শতাধিকেরও বেশি সনেট রচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রকৃতি, স্বদেশ ও মানব জীবনভিত্তিক সনেটের সংখ্যাও কম নয়। সনেটগুলি ছাড়াও আর যে সকল কবিতায় ওয়ার্ডসওয়ার্থ সারা পৃথিবীতে খ্যাতিলাভ করেছেন সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— ‘লাইনস্ কম্পোস্ড অব ফিউ মাইলস্ অ্যাবাভ্ টিনটার্ন অ্যাবে’, ‘লন্ডন’, ‘ওড টু ডিউটি’, ‘দ্য ফাউন্টেন’, ‘দ্য সলিটারি রিপার’, ‘দ্য টু এপ্রিল মর্নিং’, ‘টু এ স্কাইলার্ক’, ‘টু দ্য কাক্কু’, ‘টু দ্য ডাইসি’, ‘সেপ্টেম্বর’, ‘দ্য এক্সারসন’, ‘লাউডামিয়া’ প্রভৃতি।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ রোমান্টিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন জন্য তিনি আদ্যন্ত রোমান্টিক। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতার নানা বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্য বৈশিষ্ট্য
যে সমস্ত বৈশিষ্ট্যের জন্য ওয়ার্ডসওয়ার্থকে রোমান্টিক পট পরিবর্তনের প্রথম কবি হিসাবে ধরা হয় সেগুলি হল—
ক. প্রকৃতি চেতনা:
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন প্রকৃতির পূজারী কবি। তাঁর প্রকৃতি চেতনা চারটি স্তরে বিন্যস্ত—
প্রথমত: প্রকৃতিকে জীবন্ত সত্ত্বা রূপে উপলব্ধি করেছেন। তাই পাহাড়, নদী, অরণ্য সর্বত্রই তিনি অনুভব করেছেন প্রকৃতির সুকোমল স্পর্শ।
দ্বিতীয়ত: ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাবনায় প্রকৃতির স্পর্শেই মানুষের সকল দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে জীবনে প্রশান্তি নেমে আসবে।
তৃতীয়ত: মানুষ ও প্রকৃতির অচ্ছেদ্য বন্ধন তাঁর ভাবনায় ধরা পড়েছে। তাঁর বিশ্বাস সকলে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও প্রকৃতি কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
চতুর্থত: ওয়ার্ডসওয়ার্থের চেতনায় প্রকৃতির দ্বৈত রূপ ধরা পড়েছে। প্রকৃতি একদিকে যেমন স্নেহময়ী জননী, প্রেয়সী আবার অন্য দিকে সে ভয়ঙ্করী রুদ্রাণী।
খ. অতীন্দ্রিয়বাদ:
ওয়ার্ডসওয়ার্থের ভাবনায় প্রকৃতির ঐশী সত্ত্বা সর্বত্রই বিরাজমান। প্রকৃতিকে ভালবাসলে প্রকৃত পক্ষে ঈশ্বরকে ভালোবাসা যায়। এক কথায় প্রকৃতিকে আশ্রয় করে কবি আধ্যাত্মিক জগতে পদার্পণ করেছেন।
গ. গীতিপ্রাণতা:
ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং আত্মগত উচ্ছ্বাসের নিবিড় সমন্বয় লক্ষ করা যায়। রোমান্টিক যুগের কবি হিসেবে গীতিপ্রাণতা তাঁর কাব্যের মৌল বৈশিষ্ট্য।
ঘ. প্রশান্ত আনন্দের সুর:
ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় প্রশান্ত এক আনন্দময় অনুভূতির সুর ধ্বনিত হয়। এই আনন্দ প্রকৃতির অন্তর থেকে উঠে আসা এক সৌন্দর্যময় কবি সত্ত্বার পূর্ণ প্রতি রূপ।
ঙ. আঙ্গিকগত অভিনবত্ব:
অষ্টাদশ শতকের আড়ম্বরপূর্ণ কৃত্রিম কথ্য ভাষাকে পরিহার করে তিনি সহজ-সরল ভাষা প্রয়োগে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব:
ওয়ার্ডসওয়ার্থ রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের যে অগ্রপুরুষ ছিলেন তার প্রমাণ পরবর্তীকালের বিশ্বসাহিত্যের প্রচুর রোমান্টিক কবিদের কাব্যে তাঁর প্রভাব পড়েছে। বাঙ্গালী গীতিকবিরাও ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রথম কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্য ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব তো পড়েছিল; পরবর্তীকালে বিহারীলাল চক্রবর্তীর নেতৃত্বে বাংলা গীতিকাব্যের জয়যাত্রা শুরু হলে সে সময়কার কবিদের কবিতাতেও ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব পড়েছে। বিহারীলালের ‘সঙ্গীত শতক’, ‘নিসর্গ সন্দর্শন’ ‘সারদামঙ্গল' প্রভৃতি কাব্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। রবীন্দ্রনাথও কাব্যজীবনে ওয়ার্ডসওয়ার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনিও ওয়ার্ডসওয়ার্থের মত প্রকৃতির সাথে মানবাত্মার একাত্ম অনুভব করেছেন ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘যেতে নাহি দিব' প্রভৃতির মত অসংখ্য কবিতায়। ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘প্রিলুউড' কাব্যের চতুর্থ স্তবকের সাথে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। সুতরাং ওয়ার্ডসওয়ার্থ যে একজন বড়মাপের রোমান্টিক কবি ছিলেন এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।