-->

বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন' নাটকের সংলাপ

বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন' নাটকের সংলাপ

নাটক সংলাপ নির্ভর। সংলাপের ওপরেই নাটকের নাটকীয়তা, বিষয়বস্তুর বর্ণনা, দ্বন্দ্ব সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা, নাটকীয় বৃত্তগঠন, চরিত্রের বিকাশ বিশ্লেষণ ইত্যাদি নির্ভর করে। সাহিত্যের অন্যান্য প্রকরণগুলিতে রচয়িতার একটি নিজস্ব মাধ্যম থাকে, যে মাধ্যমে তিনি কিছু বর্ণনা, কিছু বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে কাহিনী, চরিত্র, ঘটনা প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা এবং স্থান ও কালের অনেকখানি পরিচয় দিয়ে থাকেন। নাটকে কিন্তু নাট্যকারের সে সুযোগ নেই। নাট্যকার এসমস্ত কিছুই সংলাপের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন ।

সুতরাং নাটকের একটা সংলাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্বরগ্রাম ভিত্তিক সংলাপ রচনা করতে না পারলে নাটক ব্যর্থ হয় । মনের বিভিন্ন ভাব, অনুভাব, বিভাব, সঞ্চারীভাবকে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে গিয়ে উপযুক্ত স্বর সহযোগে নিক্ষেপ করতে হয় - তাহলেই নাটক থেকে উপচিত হবে যথেষ্ট উপভোগ্য নাট্যরস। সংলাপের মধ্যেই নিহিত থাকে বাচিক অভিনয়ের বহুবিধ উপকরণ, আবার এই সংলাপের মধ্যেই অনুল্লিখিত ভাবে জড়িয়ে থাকে অঙ্গাভিনয়ের নানান নির্দেশ ।

নাটকে অভিনয় প্রক্রিয়া সংলাপের ওপরেই নির্ভরশীল। তাই যে নাট্যকার যতবেশী উৎকৃষ্ট সংলাপ রচনা করতে পারবেন সেই নাট্যকারের চরিত্র সমূহ ততবেশী সমাদৃত হবে। অনেকসময় দেখা গেছে যে, হালকা সংলাপের নাটকে সুদক্ষ অভিনেতাও সুনাম অর্জন করতে পারেন নি। কিন্তু উৎকৃষ্ট সংলাপ সংযুক্ত নাটকে তৃতীয়স্তরের অভিনেতাও অতি সহজে দারুণ অভিনয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে কৃতিত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। নিকলের মতে,আঞ্চলিক ভাষা, কমেডি নাটকের উপযোগী। ট্রাজেডি নাটকে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ট্রাজেডির রসের হানি ঘটায়। আঞ্চলিক ভাষায় সংলাপ রচিত হলে ট্রাজেডি নাটকের অভিনয়ের সময় ভাষাজনিত বিকৃতি এমন হাস্যরসের সৃষ্টি করবে যা গুরুগম্ভীর ট্রাজেডি নাটকের অপরিপন্থী।

বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' অনেকটাই আঞ্চলিক ভাষায় লেখা। বলাবাহুল্য মিলনান্তক নাটক হলেও আগাগোড়া এর মুখ্য রস বিষাদ বা ট্রাজেডি। নবান্ন মঞ্চ সফল নাটক তো বটেই, এর প্রভাব সমকাল অতিক্রমীও। সে প্রভাব একদিকে বর্তেছে সমাজে, অন্যদিকে পরবর্তীকালের নাটকে । আমিনপুরের লোকেরা বিশেষ করে প্রধান, দয়াল, কুঞ্জ—যে ভাষায় কথা বলেছে তা অনেকটা Standard Language-এর কাছাকাছি কিন্তু রাজীবলোচন যে ভাষায় কথা বলেছে তা পুরোপুরি পূর্ববঙ্গীয় সংলাপ। সে কারণে প্রথমোক্ত সংলাপ হাস্যরস উদ্রেক করেনি—কিন্তু রাজীবের সংলাপ দর্শককে হাসির খোরাক যুগিয়েছে । নবান্নে'র সংলাপ বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ আবিষ্কার করা যায়। এই বিশেষ লক্ষণগুলি নাটককে অভিনব করে তুলেছে—

১) নবান্নর সংলাপ সাদামাঠা চলিত গদ্যে লেখা, উচ্ছ্বাস নেই, কাব্যিক বাগাড়ম্বরও নেই ।

২) এই নাটকের সংলাপে চিত্রধর্মিতার কিছুটা অভাব, মঞ্চ নির্দেশের আধিক্য সংলাপকে যতটা বস্তুধর্মী করেছে ততটা চিত্ৰধৰ্মী হওয়ার সুযোগ দেয়নি ।

৩) নবান্ন-র সংলাপ বক্তব্য প্রধান ।

৪) নবান্ন-র সংলাপ জীবনধর্মী ।

নবান্ন’-র সংলাপ সহজ সরল ভাষায় রচিত । সেখানে ইঙ্গিতমাত্র নেই । গ্রামীণ সাধারণ মানুষের জীবনকথা রূপায়িত হয়েছে বলেই বুদ্ধিদীপ্ত শাণিত তির্যকতা নেই । Lagosegri, The art of Dramatic Writing’ গ্রন্থে বলেছেন—“Good dialogue in the product of characters, carefully chosen. নবান্ন-র সংলাপ নির্বাচনে নাট্যকার এই সচেতনতা বোধের পরিচয় দিয়েছেন। তাই তাঁর নাটকের চরিত্রগুলি তাদের নিজের নিজের ভাষায় কথা বলেছে । সহজেই তাদের চেনা গিয়েছে। কয়েকটি দৃশ্যের কিছু সংলাপ উদ্ধৃত করা যেতে পারে—

“কুঞ্জ। তা আমি বলি কি হে যত দুঃখ কষ্ট কপালে আছে সে তো আছেই মাঝখানে জমিটুকু খুইয়ে আর কি এমন সৌভাগ্য বাড়বে।”

এই সংলাপের ভাষা একেবারে সহজ সরল, নিতান্ত ঘরোয়া । কিন্তু একথাও বলা যাবে না যে একেবারে আঞ্চলিক ভাষা।

‘নবান্ন’-র কাহিনী বিন্যাসের ক্ষেত্রে সংলাপ রচনায় যে চিত্রধর্মিতা সৃষ্টির অবকাশ ছিল নাট্যকার সে সুযোগ নেন নি । মঞ্চসজ্জায় ও পাঠ্য নির্দেশে কিছু প্রতীকের সহায়তা নিয়েছেন মাত্র, সংলাপ রচনায় যতটুকু তির্যকতা ও রহস্যময়তা তা প্রধান এবং কয়েকটি ভদ্রচরিত্রে (ধনী চরিত্রে) লক্ষ্য করা যায়। প্রধান যখন বলেন—

এ ব্যাটা দৌড়ে পালিয়ে গেল, একেবারে ভোঁ-ও-ও-ও-ও নদ-নদী, খাল- খাদ পেরিয়ে বন বাদাড় ভেঙে যা ব্যাটা একেবারে হাওয়া গাড়ির যত দৌড়ে চলে গেল হুই

—তখন সংলাপের কিছুটা তির্যকতার - কিছুটা অসংলগ্নতার পরিচয় মেলে ।

নবান্নের সংলাপ বক্তব্য প্রধান। প্রতিটি দৃশ্যেই দেখা যায় সংলাপগুলি বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বিশেষ বক্তব্য উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিটি চরিত্রের সংলাপ উদ্ধৃত করে এই সত্যের পরিচয় দেওয়া সম্ভব। যখন দয়াল একমুঠো চালের জন্য দোরে দোরে ঘুরে বেড়ায় তখন প্রধান বলেন—

প্রধান - ছোট ভুলের ক্ষমা আছে, বুঝলে দয়াল। কিন্তু বড়ো ভুলের আর চারা নেই।

করতেই হবে তোমাকে প্রায়শ্চিত্ত। এইটাই বুঝলাম ।

কুঞ্জ (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) - হ্যাঁ বুঝলে বটে, (দয়ালের প্রতি) তবে কিনা বড্ড দেরী করে বুঝলে ৷

নবান্ননাটকের ঘটনার সংঘঠনস্থল আমিনপুর বলে এই নাটকে ব্যবহৃত চাষী মজুরের ভাষাকে মেদিনীপুরের উপভাষা বলে ধরে নিতে পারি । কলকাতা শহর আবার এই নাটকের আর একটা ঘটনা সংগঠনস্থল। সুতরাং ভাগীরথী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা শহর কলকাতার আটপৌরে ভাষার ব্যবহার দেখা যায় নবান্ননাটকে । আবার পূর্ব বাংলার উপভাষা এই নাটকে এসে গেছে রাজীবের মুখে । এছাড়া আরবী, ফার্সী শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে।

এই নাটকে ব্যবহৃত আটপৌরে ঘর-কন্নার ভাষাকে দিয়ে কি অদ্ভুতভাবে Climax গড়ে তুলেছেন নাট্যকার— দয়াল- প্রধান, সমুদ্দর, চারিদিকে শুধু সমুদ্দর -জল আর জল, কিছু নেই শুধু জল ...সমুদ্দর ওঠে মরচে গ্রামে।সেই যন্ত্রণার হাহাকার বেরিয়ে এসেছে তীব্র তীক্ষ্ণ স্বরে কুঞ্জ কুঞ্জ ডাকের মধ্যে। নাট্যকার প্রধান শব্দটা ব্যবহার করলেন না, কেননা কুঞ্জ শব্দটার ভেতর অভিনেতা কণ্ঠস্বরের ঢেউটা খেলাতে পারবেন, যে কেউ দর্শক মনে তাল তরঙ্গ তুলবে। আর একটি শব্দ সমুদ্দর। সমুদ্র বললে স্বরক্ষেপের কালসীমা যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় সমুদ্দর’ বললে তার চেয়ে অনেক বেশী হয় ।

শহুরে ভদ্র সম্প্রদায়ের স্ব-শ্রেণীর ব্যক্তি নির্মলবাবু। স্বশ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের অর্থপূর্ণতা ও দুর্ভিক্ষের বাজারে অন্ধকার পথে কামানো অর্থে ঐশ্বর্যের দত্ত প্রকাশের বিপক্ষে বিরুদ্ধ মানসিকতা পোষণ করে অর্থহীন মানুষদের পক্ষে সওয়াল করেন ৷ শহরাঞ্চলের ব্যবহৃত সহজ সরল সংলাপ,

“সে পয়সা যাদের আছে তারা বলতে পারে একথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে বেশীরভাগ লোকেরই আবার সেটা নেই কিনা !

একই দৃশ্যে মাগো মাগো' ধ্বনি দুর্ভিক্ষের হাহাকার প্রকাশের উপযুক্ত সংলাপ ।

নবান্নের সংলাপ প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন । এই নাটকের নারীচরিত্রগুলি বিশেষ করে রাধিকা যে ভাষায় কথা বলেছে—যে ভাষায় অভিমান প্রকাশ করেছে তা একান্তভাবে নারীরই । রাধিকার ভাষা আঞ্চলিক । স্বামীর প্রতি তার তির্যক ভাষণ তার সংলাপে নারীত্বের পরিচয় রেখেছে। কুঞ্জের কথার উত্তরে সে বলে

‘হ্যাঁ’ খেয়ে দেয়ে দ্যাখো না কেমন সোন্দর হাল হয়েছে শরীরের

কিংবা—

পুরুষ মানুষের কৃতিত্বের কথা আর বোলো না।'

শহুরে ভদ্রলোকের সংলাপে রয়েছে ইংরাজী, বাংলার মিশ্রণ । দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়—

বড়কর্তা - আর বোল না ভায়া, একে ব্ল্যাক আউট, তারপর আবার এই ওয়েদার, আমারই দুরদৃষ্ট আর কি ! এখন ভালোয় ভালোয় কাজটা – ”

‘নবান্ন’ নাটকে চরিত্রগুলির ভাষা অনেকাংশে তাদের নিজের ভাষা হওয়ার জন্য এই ভাষার জীবনধর্মিতা অস্বীকার করা যায় না। এরফলে প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রধান, কুঞ্জ, রাধা প্রভৃতি আমিনপুরের লোকেরা; কালীধন, রাজীবলোচন প্রভৃতি ব্যবসায়ীবৃন্দের সংলাপ চরিত্রগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছে।

নবান্ন’ নাটকের সংলাপ গণ নাটকের আসল সংলাপ । গণনাটকে গণচেতনা বৃদ্ধির একটা সচেষ্ট প্রয়াস থাকে । সেই চেষ্টাকে সফল করে তুলবার জন্য নাট্যকারকে সচেতন হতে হয় । নাটককে অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া সেই সচেতনতার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কাছে নাটককে নিয়ে যেতে গেলে, সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে তুলতে গেলে সংলাপকে সর্বজনবোধ্য করে তুলতে গেলে সহজ, সরল শব্দ অতি প্রচলিত সাধারণ শব্দ দিয়ে সংলাপের দেহ গঠন করতে হয় । সেদিক থেকে নবান্ন নাটক যথেষ্ট সফল হয়েছে বলা যেতে পারে ।