-->

নাট্যকার মধুসূদন দত্ত

নাট্যকার মধুসূদন দত্ত

বাংলা নাট্যসাহিত্য মধুসূদন দত্তের অবদান:

প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার যাকে ‘দৃশ্যকাব্য’ বলা হত আজ তাকেই বলা হয় নাটক। কিন্তু বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে যে আধুনিক রূপটি আমাদের হাতে এসেছে সেটি ইংরেজি নাট্য-সাহিত্যের প্রভাবজাত। আজ আমরা ‘নাটক’ বলতে ‘থিয়েটার’ শব্দের প্রতিশব্দকে বুঝে থাকি। উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের সূত্র ধরেই মিশ্র শিল্পের প্রসার। উনিশ শতকের গোড়ায় বিদেশী ইংরেজদের উৎসাহে এবং কিছু কিছু বিত্তবান বাবুদের আগ্রহে কলকাতা শহরে নাটক অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়েছিল, হেরাসিম স্তেফানভিচ্‌ লেবেডেফ, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর—প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আর নাটক রচয়িতা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল জি. সি. গুপ্ত (কীর্তিবিলাস), তারাচরণ শিকদার (ভদ্রার্জুন), হরচন্দ্র ঘোষ (ভানুমতী চিত্তবিলাস), রামনারায়ণ তর্করত্ন (কুলীন কুল সর্বস্ব) প্রমুখ।

কিন্তু বাংলা নাটকের ইতিহাসে আধুনিক ইউরোপীয় ধারার সূত্রপাত মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে। বঙ্গের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে প্রথম এসেছিলেন নাট্যকার রূপে। খানিকটা আকস্মিক ভাবে বাংলা নাটকের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। বেলগাছিয়া থিয়েটারে ‘রত্নাবলী’ নাটকের অভিনয় আমন্ত্রিত হয়ে মধুসূদন বাংলা নাটকের দৈন্যদশা দেখাছে, হতাশ হয়ে লিখেছিলেন—

“অলীক কুনাট্য রঙ্গে         মজে লোকে রাঢ়েবঙ্গে

নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।”

অতঃপর বাংলা নাটকের ইতিহাসে মধুসূদনের আবির্ভাব এক ঐতিহাসিক কাজকর্মের সূচনা। মধুসূদনের লেখা নাটকের সংখ্যা খুববেশি নয় পূর্ণাঙ্গ নাটক মাত্র ছয়টি—‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০), ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১), ‘মায়াকানন’ (১৮৭৪), ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০), ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০)। 

এই নাটকগুলিকে সাহিত্যর ঐতিহাসিকরা তিনটি পর্যায়ের ভাগ করেছেন—

১) পুরাণ আশ্রিত নাটক বা পৌরাণিক নাটক—‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’।

২) ইতিহাস আশ্রিত নাটক বা ট্র্যাজেডি নাটক—‘কৃষ্ণকুমারী’।

৩) প্রহসন—‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’।

‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের কাহিনি মহাভারতের যযাতির উপাখ্যান; শর্মিষ্ঠা-দেবযানী-যযাতীকে নিয়ে রচিত। মূল আখ্যানের কোনো কোনো চরিত্রকে মধুসূদন অধিকতর বিশুদ্ধ চরিত্রাদর্শনের দ্বারা নবরূপ দান করেছে। ‘পদ্মাবতী’ নাটকটি গ্রিক পুরাণের বিখ্যাত গল্প Apple of Discord বা স্বর্ণ আপেলের কাহিনি ভারতীয় পটভূমিতে বিধৃত হয়েছে।

মধুসূদনের সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক হল ‘কৃষ্ণকুমারী’। এই নাটকের কাহিনি সংগৃহীত হয়েছে কর্ণের জেমস টডের  Annals And Antiquities Of Rajasthan’ গ্রন্থ থেকে। মেবারের রাজা ভীম সিংহের অপরূপ সুন্দরী কিশোরী কন্যা কৃষ্ণকুমারীকে ঘিরে রাজপুত বীর জয় সিংহ, জগৎ সিংহ ও মরুদেশের মুসলমান যোদ্ধাদের সংঘর্ষ ঘনিয়েছে। সেই সংকট নিরসনে নিষ্পাপ কৃষ্ণকুমারীকে জীবন দিতে হয়েছিল। সেই করুন বেদনার কাহিনিই রয়েছে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে।

সমালোচকদের বিচারে প্রহসন রচনার ক্ষেত্রে মধুসূদন সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছিল। মাত্র দুটি প্রহসনধর্মী রচনার মধ্যদিয়ে এই সফলতা এসেছে এবং বাংলা নাট্য সাহিত্যে শুরু হয় একটি নতুন ধারা। যে ধারায় পরবর্তীতে এসেছিল দীনবন্ধু মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমৃতলাল বসু প্রমুখ নাট্যকারগণ। মধুসূদনের দুটি প্রহসনই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রচিত হয়েছিল। ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ (১৮৬০) নামকরণে যে প্রশ্ন চিহ্নটি রয়েছে সেটি উচ্চারিত হয়েছে নাটকের একেবারে শেষে এক নারী চরিত্র হরকামিনীর কণ্ঠে। এই প্রহসনের বিষয়বস্তু হল—উনিশ শতকের নব্য ইংরেজি শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়ের আধুনিক ইংরেজিয়ানা দেখানোর ছলে মদ্যপান করত, বাইজি গৃহে রাত্রিযাপন করত এবং পারিবারিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়েছে এবং সংস্কার মুক্তির নাম করে ব্যভিচার করাকেই এইসব নব্য যুবকদের অধিকার বলে গণ্য করছে। অথচ নিজগৃহের স্ত্রী বা ভগ্নিদের তারা মুক্তির আলো দেখাতো না। তাই নাটকের শেষে প্রশ্ন তোলা হয়েছে একেই কি বলে সভ্যতা?

‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকের বিষয়বস্তু কোন সমসাময়িক সময়ের সীমায় আবদ্ধ নয়। বৃদ্ধ পুরুষের সুন্দরী যুবতীদের প্রতি আকর্ষণবোধ, লালসা আবহমান কাল ধরেই সমাজে রয়েছে। বিষের করে বিত্তজন, ক্ষমতাবান বৃদ্ধেরা অসহায় যুবতীর প্রতি এ জাতিয় অপরাধ মাঝে মাঝেই করেন। এই প্রহসনে তার বিরুদ্ধে হাস্যরসাত্মক প্রতিবাদই উচ্চারিত হয়েছে। পরবর্তীতে এর প্রভাবে দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন—‘বিয়ে পাগল বুড়ো’।

বাংলা নাটক ঐতিহাসিক দিক থেকে মধুসূদনের কাছে সবচেয়ে ঋণী। একালে নাট্য শিল্প বিচার করলে তাঁর সব নাটক হয়তো অতি উৎকৃষ্টমানের রচনা বলে গণ্য হবে না; কিন্তু বাংলা নাটকের একটি শুভ সূচনা তার মধ্য দিয়ে হয়েছিল। কেবল আধুনিক বাংলা কবিতা নয় আধুনিক বাংলা নাটকেরও অগ্রপথিক ছিলেন মধুসূদন দত্ত।