ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের সার্থকতা
ইতিহাস থেকে তথ্য, ঘটনা উপাদান সংগৃহীত করে ও প্রয়োজন মতো সাহিত্যিক কল্পনার সংমিশ্রণে নাট্যকার যে নাটক লেখেন তাকেই বলে ঐতিহাসিক নাটক। নাট্যকার যখন অতীত ইতিহাসের ধূলিধূসর প্রান্তর থেকে আহৃত কোন কাহিনী অবলম্বন করে নাটক রচনা করেন তখন সেই নাটককে আমরা স্থূল অর্থে ঐতিহাসিক নাটক বলতে পারি, তবে সার্থক ঐতিহাসিক নাটকের ক্ষেত্রে কেবল উক্ত শর্তটুকু পূরণ করলেই হয় না। নাটককে সর্বাংশে ঐতিহাসিক নাটক হয়ে উঠতে গেলে আরও অনেকগুলি শর্ত পূরণ করতে হয়।
সার্থক ঐতিহাসিক নাটকের প্রথম শর্তটি হল এর বিষয়বস্তু বা কাহিনীবৃত্ত ইতিহাসের যে অধ্যায় বা ঘটনা থেকে সংগৃহীত হোক না কেন সাহিত্য প্রকরণের দিক থেকে এটিকে অবশ্যই নাটক হতে হবে। অর্থাৎ নাটকের প্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতসহ নাটকীয়তায় পূর্ণ হতে হবে।
ঐতিহাসিক নাটকের ক্ষেত্রে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ইতিহাস এবং অনৈতিহাসিকতার বিরোধ। নাট্যকার ঐতিহাসিক নন তাই ঐতিহাসিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি কেবল ইতিহাসের বিবরণ লিখতে বসেন না। তিনি ইতিহাসের বস্তুসত্যকে গ্রহণ ও বর্জন করে কিছুটা রঞ্জিত করে একটি ভাবসত্য নির্মাণ করেন। ইতিহাসের অন্ধ দাসত্ব না করে নাট্যকার তার স্বাধীন সৃজনশীল কল্পনার মাধ্যমে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য মানবিকরূপ প্রদান করেন। অবশ্য এই কাজ করতে গিয়ে নাট্যকারকে অবশ্যই ইতিহাসের তথ্য ও সত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকতে হয়। নাটকের প্রয়োজনে ঐতিহাসিক সত্যের বিকৃতি করতে পারেন না। মূল ঐতিহাসিক সত্যের কোন বিকৃতি না ঘটিয়ে নাট্যকার ইতিহাসের চরিত্র বা ঘটনার মধ্যে অনাবিষ্কৃত ও অনুদ্ঘাটিত রহস্য ও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
ঐতিহাসিক নাটকের জন্য কেবল ইতিহাসের অবলম্বনই শেষ কথা নয়। এই জাতীয় নাটকের কাহিনীর মধ্যে ইতিহাসের রস সঞ্চারিত করতে হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের রণোন্মাদনা, ঐশ্বর্যের হিরণ্যদীপ্তি, মত্তমদির প্রমত্ততা, শক্তি সম্পদের প্রতি শেষহীন লুব্ধতা, পারস্পরিক কুটিল হানাহানি প্রভৃতি বিষয়কে নিয়েই ঐতিহাসিক নাটকের চালচিত্রটি প্রস্তুত করা হয়। ফলত নাটকের পাঠক ও দর্শক ঐতিহাসিক নাটকের পাঠ বা দেখার সময় ইতিহাসের সুদূর অতীতে উপনীত হতে পারেন। এভাবেই ইতিহাসের রস তাদের মনে সঞ্চারিত হয়। ইতিহাসের রস সৃষ্টির জন্য নাটকের সংলাপ ও ভাষাকেও বিশেষ ভাবে নির্মাণ করতে হয়। ড. অজিত কুমার ঘোষের মতে, ঐতিহাসিক নাটকের ভাষা হবে বলিষ্ঠ ও গম্ভীর। সেজন্য তৎসম ও সমাসবদ্ধ পদের বহুল ব্যবহার আবশ্যক।
‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক রচনার পশ্চাতে আছে জেমস টডের লেখা ‘Annals and antiquities of Rajasthan’-নামক গ্রন্থটি। মাইকেল একাধিক পত্রে নাট্যকাহিনীতে টডের ‘রাজস্থান’ গ্রন্থটির উল্লেখ করেছেন। সমকালে তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লিখিত এক পত্রে তিনি জানিয়েছেন—“The plot is taken from Tod, vol. I.P.461. I suppose you are well acquainted with the story of the unhappy princess Krishna Kumari ” অন্য একটি পত্রে মাইকেল কেশব গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছেন— “For two nights, I sat up hours pouring over the tremendous pages of Tod and about I A.M. last saturday the muse smiled!” সুতরাং উক্ত পত্রাংশ দুটি থেকে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মাইকেলের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কাহিনী টডের ‘রাজস্থান’ নামক গ্রন্থটি থেকে গৃহীত।
মধুসূদন পূর্ববর্তী দুটি নাটকের কাহিনী আহরণ করেছিলেন মহাভারত ও গ্রীক পুরাণ থেকে। শর্মিষ্ঠা নাটকে মাইকেল মহাভারতের কাহিনীকে রূপ দিয়েছিলেন আর পদ্মাবতী নাটক রচনা করেন গ্রীকপুরাণের কাহিনী অবলম্বন করে। সেদিক থেকে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকটির যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য আছে কারণ ‘কৃষ্ণকুমারী’ই বাংলা নাট্যসাহিত্যে সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু অবলম্বনে রচিত। প্রসঙ্গত ড. সুকুমার সেন লিখেছিলেন—“ইতিহাস হইতে আখ্যানবস্তু গ্রহণ করিয়া লেখা বাঙলা নাট্যরচনার মধ্যে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক প্রথম।” ড. সুকুমার সেন যদিও কৃষ্ণকুমারী নাটকের আখ্যানবস্তু টডের ‘রাজস্থান’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত বলে স্বীকার করেন নি। তাঁর মতে, ১৭৭৯ শকাব্দের (অর্থাৎ ১৮৫৭-৫৮ খ্রীস্টাব্দের) পৌষ সংখ্যা ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ নামক পত্রিকায় প্রকাশিত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকুমারীর ইতিহাস’ প্রবন্ধটি এই নাট্যকাহিনীর উৎসস্বরূপ। তাই ড. সেন মন্তব্য করেছিলেন—“কৃষ্ণকুমারী নাটককে সর্বাংশে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় না।”
টড্ বর্ণিত বা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধের দ্বারা প্রভাবিত হলেও মধুসূদন তাঁর ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে ইতিহাস-চেতনাকে একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক ঘটনা, তদনুযায়ী চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও পটভূমির মধ্য দিয়ে নিজস্ব শিল্পরীতির মাধ্যমে স্থান-কাল ও ঘটনাগত বা ক্রিয়াগত ঐক্যকে সীমিত কালের আয়তনেও নিজস্ব শিল্প রস সচেতন ব্যঞ্জনাদান করেছেন। এই কারণে ইতিহাসের সত্য যেমন রক্ষিত হয়েছে—তেমনি মাঝে মাঝে ইতিহাসের সম্ভাব্য কল্পিত পরিবেশেরও প্রয়োগ মধুসূদন করেছেন। অতীত ইতিহাসের রাজপুত জাতির শৌর্য বীর্যকে মধুসূদন সমসাময়িক কালের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে কৃষ্ণকুমারী নাটকে ইতিহাস চেতনাকে, পারিপার্শ্বিক দেশ-কালের আয়তন সম্পৃক্ত এক গভীরতা দান করেছেন। নাটকটির কেন্দ্রীয় রসপ্রবণতাকে অর্থাৎ স্বাদেশিক আনুগত্যকে এমনভাবে রূপান্তরিত করেছেন, দেশ ও কালের বিরাট ব্যবধান সত্ত্বেও কৃষ্ণকুমারী নাটকের ইতিহাস চেতনায় সমকালীনতা সমাক্রান্ত হয়ে এক নতুনত্ব এনে দিয়েছে। দূরত্বের ব্যবধান ঐতিহাসিক রসের ত্রুটি না ঘটিয়ে বরং নাট্যকারের সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় স্বতন্ত্র সাফল্য পেয়েছে।
রাজা ভীম সিংহের চরিত্রাঙ্কনে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব টডের কাহিনীর মধ্যে যে জাতীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিরাজমান—মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারীতে ভীম সিংহের চরিত্রে ঐতিহাসিক তথ্য সংরক্ষিত হলেও বিষাদমগ্ন গাম্ভীর্যের দিকটি অধিকমাত্রায় সফল হয়ে উঠেছে। জগৎ সিংহ ও বলেন্দ্র সিংহের চরিত্র রচনায় মধুসূদন টডের ইতিহাস অনুসরণে সফল হয়েছেন বলা যায়। ধনদাস চরিত্রে খলনায়কের ভূমিকাকে শেক্সপীয়ারের ইয়াগোর মত করে তুলতে না পারলেও মধুসূদন এখানে সেই চেষ্টার মাধ্যমে সমকালীন ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক পটভূমিকে চরিত্রটির শঠতা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার আশ্রয়ে যথার্থ ঐতিহাসিক পার্শ্বচরিত্র হিসেবে মর্যাদা দিতে পেরেছেন।
জগৎসিংহ ও মানসিংহের যে বিরোধ ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে উপস্থাপিত করা হয়েছে, সেখানেও মাইকেল ইতিহাসের পটভূমি, চরিত্র ও কাহিনীর অনুসরণকে ঐতিহাসিক মর্যাদা দিয়েছেন। বিলাসবতী চরিত্রটি অন্যতম নাটকীয় জটিল চরিত্র—তার স্বার্থেই মদনিকার চক্রান্ত কৃষ্ণকুমারী ঐতিহাসিক নাটককে নাটকীয় জটিল আবর্তের সম্মুখীন করেছে। মানসিংহের দ্বারা কৃষ্ণাকে বিবাহের বাসনা প্রকাশ প্রসঙ্গটি অবশ্য নাটকে সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক ও কল্পনা নির্ভর। এই অনৈতিহাসিকতাকে প্রাধান্য দেবার কারণেই জগৎসিংহ ও মানসিংহের মধ্যে বিরোধ এই নাটকে শেষপর্যন্ত প্রত্যক্ষ চক্রান্তে রূপায়িত হয়েছে। ইতিহাসের সত্য রক্ষা করতে গিয়ে মধুসূদন মানসিংহকে দৃশ্যমাধ্যম হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত না করলেও মদনিকা চরিত্রের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের পাশে আমরা অপ্রত্যক্ষভাবেই যেন এই চরিত্রটিকে লক্ষ্য করে থাকি।
কৃষ্ণকুমারী নাটকে অহল্যা, তপস্বিনী, ধনদাস ইত্যাদি চরিত্রগুলি ইতিহাসের অনুসরণে আগত নয়। প্রসঙ্গত ড. অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—“মধুসূদন কয়েকটি চরিত্রের নামের পরিবর্তন করেছেন। যেমন মহারাজা জোয়ান দাস হয়েছেন বলেন্দ্র সিংহ, কর্পূর মঞ্জরীকে করেছেন বিলাসবতী, মন্ত্রী সতী দাস হয়েছেন সত্য দাস ইত্যাদি। আর এই সঙ্গে তিনি জুড়ে দিয়েছেন কয়েকটি কাল্পনিক চরিত্র যেমন মদনিকা, ধনদাস, তপস্বিনী প্রভৃতি।” অবশ্য কাহিনীর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চক্রান্ত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার গতিময়তার সঙ্গে ইতিহাস সম্মত এবং ঐতিহাসিক নাটকের বিশেষ রসের অনুমোদনের ক্ষেত্রে নাট্যকারের ঐতিহাসিক কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ দোষনীয় নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ প্রবন্ধে মত প্রকাশ করে লিখেছিলেন-“রসের সৃজনটাই উদ্দেশ্য, অতএব সেজন্য ঐতিহাসিক উপকরণ যে পরিমাণে যতটুকু সাহায্য করে সে পরিমাণে ততটুকু লইতে কবি কুণ্ঠিত হন না।” সুতরাং লেখকের কাজ যেমন ইতিহাসের অন্ধ অনুসরণ নয় মাইকেলও তেমনি কৃষ্ণকুমারী নাটকে সামান্য পরিমাণে ঐতিহাসিক কল্পনার আশ্রয় ও অনৈতিহাসিক চরিত্রকে ভিত্তি করে ঐতিহাসিক নাটকের বহিরঙ্গ স্বরূপকে বজায় রেখেছেন।
মাইকেল টডের ইতিহাসকে বিস্তৃত রূপদান করে ঐতিহাসিক ফলশ্রুতি দিতে চান নি। কারণ নাটক রচনা করতে গিয়ে তিনি ইতিহাসরোধ অপেক্ষা নাট্য সম্ভাবনার ট্র্যাজিক শৈলীর প্রতি অধিক যত্নশীল ছিলেন।
টডের আরও বহু কাহিনীর নাট্যসম্ভাবনাকে কৃষ্ণকুমারী নাটকে মাইকেল ব্যবহার করতে পারতেন কিন্তু নাট্যকারের মানসিক ধারণা ছিল, তাতে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি ব্যক্তিত্ববোধ থেকে শিথিল হয়ে পড়বে এবং সেই শিথিলতার সঙ্গে সঙ্গেই ইতিহাস চেতনার মধ্যেও ব্যর্থতা আসবে। তাই মধুসূদন টডের রাজস্থান থেকে শুধুমাত্র সেই অংশটুকু গ্রহণ করেছেন— যার মধ্যে রাজপুত জাতির পতনের বিলীয়মান সূর্যরশ্মির পাণ্ডুর রেখাটি বড় হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, নাট্যকারের এই ঐতিহাসিক চেতনার মধ্যেও নিঃসন্দেহে তাঁর মানসিক দ্বন্দ্ব এবং কাহিনীটির সীমাবদ্ধতাই লক্ষ্যমুখী হয়ে থেকেছে।
মাইকেল কৃষ্ণকুমারী নাটকে রাজপুত ইতিহাসের অষ্টাদশ শতকের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ আবহাওয়াকে ইতিহাসের পটভূমিরূপেই আনতে চেয়েছেন—সেক্ষেত্রে গৃহবিবাদ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, রাজপুত জাতির অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়াস, অপমান সহ্য করার গ্লানি এবং অপরদিকে সুতীক্ষ্ণ আত্ম-সম্মানবোধ এই নাটকের কাহিনী অংশকে ঐতিহাসিক বাতাবরণে আবদ্ধ করেও তীব্র সংঘাত জাগিয়ে তুলেছে। সামাজিক জীবনের ক্ষুদ্র লোভ, ঈর্ষা এবং বিবাদকে সংস্থাপিত করে নাট্যকার, কাহিনীর মধ্যে ঐতিহাসিক ও নাটকীয় দুই প্রয়োজনই মিলিয়ে দিয়েছেন। ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে কৃষ্ণকুমারী এভাবেই সফল হয়ে উঠেছে।