‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে নায়ক হিসেবে নবকুমারের সার্থকতা
'বাংলা সাহিত্যের নরনারী' গ্রন্থে অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী মন্তব্য করেছেন : “একেই কি বলে সভ্যতা'র নায়ক নববাবু একটা শ্রেণীরূপের প্রতিনিধি । এমনকি, নববাবু যে কোনো ব্যক্তির নাম নয়, ইংরাজি-পড়া নূতন নববাবুর দল বা ইয়ং বেঙ্গল, তাহা তৎকালীন লোকেরাও বুঝিয়াছিলেন।” প্রবীণ সমালোচকের এই মত অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে আলোচ্য চরিত্রটি সম্পূর্ণভাবে তার শ্রেণীচরিত্রের লক্ষণের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে নেই, তাকে অতিক্রম করে তার ব্যক্তি-লক্ষণও অনেকাংশে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
এই প্রহসনে নবকুমার চরিত্রটি তাই সব দিক দিয়ে প্রাধান্য পেয়েছে এবং এটি অন্যান্য চরিত্রের তুলনায় অনেক বেশি পূর্ণতাও লাভ করেছে। অন্য যে কোন চরিত্র এখানে হয় বৈপরীত্যের সৃষ্টি করে, না হয় একটা তুলনার ভাব জাগিয়ে তুলে, আলোচ্য চরিত্রেরই নানা দোষ-গুণ, নানা অসংগতিকে পরিস্ফুট করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এই প্রহসনের প্রত্যেক অঙ্কের প্রত্যেক দৃশ্যেই নবকুমারকে দেখা যায় ৷ প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে তার উপস্থিতি তুলনামূলক ভাবে কিছুটা কম হলেও, তার প্রাধান্য এতটুকুও কমেনি। কারণ, কর্তাকর্তৃক প্রেরিত হয়ে এখানে বাবাজী এসেছে তারই গতিবিধি লক্ষ্য করতে। অবশেষে এই দৃশ্যের শেষভাগে বালীকে সঙ্গে নিয়ে নবকুমার আকস্মিকভাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ঘুষের প্রলোভন দেখিয়ে বাবাজীকে বশ করে ফেলেছে। ফলে, বাবাজীকে এর আগে মাতাল সন্দেহে বারাঙ্গনাদের গালি হজম করতে হয়েছে, পুলিনী হাঙ্গামার তিক অভিজ্ঞতা হজম করতে হয়েছে— এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে সংযোগসূত্র আবার স্থাপিত হয়েছে নবকুমারকে কেন্দ্র করেই।
প্রথম থেকেই নবকুমার নিঃসন্দেহে আমাদের দৃষ্টি-আকর্ষণ করে । তার চরিত্রে বহু গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায়। শুরুতেই দেখি সে ধীরভাবে ভাবতে পারে, আবার হঠাৎ বিপদে পড়লে কেমন করে জাল কেটে সুকৌশলে বেরিয়ে আসতে হয়, তাও তার অজানা নেই। বৃন্দাবন থেকে কর্তা ফিরে এসেছেন, ছেলের চাল-চলনের দিকে তাঁর প্রথম দৃষ্টি—এই অবস্থায় বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে 'জ্ঞানতরঙ্গিণী সভা'য় গিয়ে স্ফূতির জোয়ারে গা ভাসানো মুশকিল ! তবুও কৌশল উদ্ভাবন করতে তার খুব একটা দেরি হল না । দৃষ্টিভঙ্গী তার খুবই প্রখর । কোন্ মানুষের কোথায় দুর্বলতা, তা সে একদৃষ্টিতেই বুঝে নিতে পারে । তাই সে অনায়াসেই বন্ধু কালীনাথকে বৈষ্ণব-সন্তান বলে পরিচয় দিয়ে, 'জ্ঞানতরঙ্গিণী সভা'কে সংস্কৃত-জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান বলে জানিয়ে, সেখানে যাবার অনুমতি সংজেই আদায় করে নিল। পরেও দেখেছি, নিষিদ্ধপল্লীতে যখন সে বাবাজীর হাতে ধরা পড়ে গেল, একদৃষ্টিতে মানুষ চেনার এই সূক্ষ্ম ক্ষমতাবলেই সে বুঝে নিল উৎকোচের টোপ এই লোভী বৈষ্ণবটি প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। এই পথেই সে-যাত্রায় তারা নিষ্কৃতি পেয়েছিল ।
সামান্য খুঁটিনাটি বিষয়েও নবকুমার কত সচেতন, ভাবলে অবাক হতে হয় । বাড়িতে মদ খাবার পর কালীকে জোরে কথাবার্তা বলতে সে নিষেধ করেছে পান খেয়ে মুখের দুর্গন্ধ দূর করবার পরামর্শ দিয়েছে। কর্তাকে মনে মনে সে যে কিছুটা ভর করে, অন্তত অপরিণামদর্শীর মতো সহসা প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে সে লিপ্ত হতে চায় না—এসব ঘটনা তারই প্রমাণ । শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্যে সে কর্তা সম্পর্কে যে-সব কটু কথা উচ্চারণ করেছে, তা অবশ্য সম্পূর্ণই মত্ত অবস্থায় এবং তার গোপন আচার-আচরণ ঘটনাচক্রে যখন কর্তার কাছে ফাঁস হয়েই গেছে, একমাত্র তখনই । তার চরিত্রের আর একটা দিক তার আত্মসংযত এবং বুদ্ধিপ্রখর আচরণ। এই দিকগুলি অবশ্য তার বন্ধু কালীনাথের বেসামাল আচরণের পাশাপাশি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এই চরিত্রের কিন্তু আরো একটা উল্লেখযোগ্য দিক হল বিদ্যাবুদ্ধি, স্মরণশক্তি এবং নেতৃত্বদানের ক্ষমতা তথা ব্যক্তিত্ব। 'জ্ঞানতরঙ্গিণী সভা'য় তার ভাষণের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করতে পারি তার ইংরেজি বিদ্যা, পর্যবেক্ষণী শক্তি, কার্যকারণ সম্বন্ধ জ্ঞান এবং সমাজ-সচেতনতার পরিচয় । সে জানে আমাদের সমাজে জাতিভেদ প্রথা, নারীজাতির প্রতি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের কতখানি দুর্বল করে রেখেছে । সে বুঝেছে এর মূলে অটল হয়ে বসে রয়েছে কুসংস্কারের জগদ্দল পাথর। সেই পাথরকে না সরাতে পারলে আমাদের মুক্তি নেই এবং জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যুক্তিবোধকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই সেই অসাধ্যসাধন সম্ভবপর হবে। তাই দেখি বন্ধু মহেশ তার অনুপস্থিতিতে তার বিদ্যাবৃদ্ধি সম্পর্কে যে মন্তব্যই করুক না কেন, সে যখন উপস্থিত হল, তার নেতৃত্বকে কার্যত অস্বীকার করবার ক্ষমতা কারো রইল না । সে ভিন্ন ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, তবুও ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা” এবং জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’—নাম দুটি তার নিখুঁতভাবেই মনে আছে। তাই কালীনাথ গ্রন্থটির নাম উল্টোপাল্টা উচ্চারণ করার পরে একসময় নবকুমার তার 'মেমারি' নিয়ে ঠাট্টা করতে ছাড়েনি। এতগুলি গুণে প্রহসনকার গুণান্বিত করেছেন নবকুমারকে। কিন্তু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে গুণগুলি আভাসে-ইঙ্গিতেই ব্যক্ত হয়েছে, সুস্পষ্ট কোনো রূপ লাভ করেনি ।
এর অবশ্য একটা কারণও আছে। গুণগুলি সুস্পষ্ট হয়ে উঠলেই তা বেশি-মাত্রায় পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণ করে ‘সধবার একাদশী'র নিমচাঁদের মতো ট্র্যাজিক-চরিত্রে পরিণত হবার উপক্রম হত— প্রহসনের চরিত্র হয়ে উঠত না। কাজেই প্রহসনকার সে-চেষ্টা না করে, তার চলন-বলন-মননের ভিতর নানা অসংগতির বীজকে প্রদর্শন করে, তার চারিত্রিক বিকৃতিকে ফুটিয়ে তুলে আপন উদ্দেশ্য নিষ্ঠারই পরিচয় দিয়েছেন। পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনায় তাই কোন চারিত্রিক বিকাশ দেখানো লেখকের লক্ষ্য ছিল না, তার মেজাজ ও মর্জির ঘন ঘন পরিবর্তনটাকেই তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন ।
দোষে-গুণেই মানুষের চরিত্র সজীব হয়ে ওঠবার অবকাশ পায়। নবকুমারের চরিত্রেও অনেক গুণের আভাস আমরা ইতঃপূর্বে দেখলাম । কিন্তু তার চরিত্রে কতকগুলো মারাত্মক দোষেরও অভাব নেই । প্রহসনের প্রথমেই দেখা যায় পিতার কাছে বন্ধু কালীনাথের মিথ্যে পরিচয় দান করার ব্যাপারে তাকে প্ররোচনা যোগাতে তার বাধেনি। এ-ঘটনায় তার প্রতারক মনোভাবের এবং পিতার প্রতি শ্রদ্ধাহীন মানসিকতার পরিচয় পাওয়া গেল। 'জ্ঞানতরঙ্গিণী সভা'য় তার কথায় ও আচরণে স্বধর্মে আস্থাহীনতা, মদ্যপান, নিষিদ্ধ মাংস গ্রহণ এবং বারাঙ্গনা-সেবার পরিচিতি মেলে। বাবাজী উৎকোচ গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু তাকে সে আপন স্বার্থেই প্রলুব্ধ করে উৎকোচ-প্রদান করেছে—এ দায়িত্বও সে এড়িয়ে যেতে পারে না। বক্তৃতায় যার সমাজ-সংস্কারের কথার ছড়াছড়ি, নিজেই সে এহেন সমাজবিরোধী আচরণ কবে বসে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সে জেহাদ ঘোষণা করতে গিয়েও আর এক কুসংস্কারের ফাঁদে এসে পড়েছে। তার ধারণা যেন হিন্দুদের পৌত্তলিকতা ও নানা সংকীর্ণ মানসিকতার গণ্ডি থেকে উদ্ধার পেতে গেলে কোন চারিত্রিক-মানসিক দৃঢ়তা অর্জনের প্রয়োজন নেই, কোন সাধনার দরকার নেই—স্রেফ মদ্য, নিষিদ্ধ মাংস আর বারাঙ্গনাবিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেই চলবে ।
এই কুসংস্কারেরই আর এক পরিণাম অন্ধ বিলেতিয়ানা । এর প্রভাবেই সে খেমটা নাচকে ‘বল্ নাচ' বলে অভিহিত করে বলে: “কম্, ওপেন দি বল, মাই বিউটিস্ ।” বারাঙ্গনাকে আহ্বান জানায় সম্পূর্ণ বিলেতি রীতিতে—“ও পয়োধরি, তুমি, ভাই, আমার আরম্ নেও।” এসবের রেশ বাড়িতে এসেও চায় ৷ বোনের গালে সে চুমো খেতে চায়। বোন আপত্তি করলেই যুক্তি দেখায়, “সায়েবরা যে বোনের গালে চুমো খায়, আর মরা কল্লেই কি দোষ হয় ?” আসলে দুই দেশের সামাজিক রীতিনীতিতে যে দুস্তর ব্যবধান রয়েছে, তা সে সম্পূর্ণই বিস্মৃত হয়ে গেছে ঐ বিলেতিয়ানাকে যান্ত্রিকভাবে অনুকরণ করতে গিয়েই। অথচ মুখের কথায় (যেমন, ‘জ্ঞানতরঙ্গিণী সভা’য় বক্তৃতা- স্থানকালে ) সে “বিদ্যাবলে সুপরষ্টিসনের শিকলি কেটে ফ্রী” হওয়ার কথা অনায়াসেই বলে । এখানে 'বিদ্যাবল' বলতে সে নিশ্চয়ই যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করার কথা বুঝিয়েছে । উক্ত উক্তির “ফ্রী” হওয়া কথাটিও লক্ষ্য করবার মতো। শব্দটির প্রকৃত অর্থ মানসিক সংকীর্ণতা থেকে মুক্তিলাভ। কিন্তু নবকুমারের আরোপিত তাৎপর্য যে কত মারাত্মক, তা তার পরবর্তী উক্তিতেই ধরা পড়েছে : “জেন্টেলম্যেন, ইন্ দি নেম্ অব ফ্রীডম, লেট, অস এঞ্জয় আওরসেলভস্।” “ফ্রীডমে”র এই নতুন তাৎপর্য তার কথাতেই শুধু আবদ্ধ হয়ে থাকে নি । পরক্ষণেই সে সুরা ও সাকীর কদর্য স্রোতে মত্ত হয়ে প্রমাণ করেছে শব্দটির ব্যবহারিক তাৎপর্য তার দৃষ্টিতে কি হওয়া উচিত। প্রহসনের শেষ দৃশ্যে মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে নবকুমার যখন নানা উৎপাত শুরু করল, তখন তার স্ত্রী হরকামিনী প্রসন্নর কাছে একান্তে বলেছিল : “হায়, এই কল্কেতায় যে আজকাল কত অভাগা স্ত্রী আমার মতন এইরূপ যন্ত্রণা ভোগ করে তার সীমা নাই। ...তোকে বলতে কি ভাই, এই সব দেখে শুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি।” আর নবর বাড়ি ফেরবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই সে আর একবার প্রসন্নকে পরিহাস-ছলে বলেছিল : “ঠাকুরঝি, তুই ভাই তোর দাদাকে নে না কেন ? আমি না হয় বাপের বাড়ী গিয়ে থাকি ; তোর ভাতার তো তোকে একবার মনেও করে না।” হরকামিনীর এই উক্তি দুটো একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে সে উচ্ছৃঙ্খল স্বামীর ঘরেই যেন একটা বন্দিনীর জীবন যাপন করছিল, তাই সে হয় বাপের বাড়ি গিয়ে, নয় গলায় দড়ি দিয়ে মুক্তি পেতে চেয়েছে । আর প্রসন্নকে ঐ স্থুল আদিরসাত্মক মন্তব্য করা এবং তার বিকৃত উচ্চারণভঙ্গীই প্রমাণ করেছে সে যথেষ্ট শিক্ষিতা নয়। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নবকুমারের বক্তৃতায় “তোমাদের মেয়েদের এজুকেট কর--তাদের স্বাধীনতা দেও” কথাগুলো রীতিমত বৈপরীত্যের সৃষ্টি করে। কারণ, ঐ নারীশিক্ষা ও স্ত্রীস্বাধীনতার আলোক থেকে তার নিজের ঘরই বঞ্চিত থেকে গেছে—যদিও সভাপতির বক্তৃতায় অবাধে সে ঐসব কথারই ফোয়ারা ছুটিয়েছে।
নবকুমার চরিত্রটির নানাদিক সম্পর্কে এই ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখতে পাই চরিত্রটি দোষে-গুণে একটা সজীব চরিত্র বটে, কিন্তু তার কথায় ও কাজে, চলায় ও বলায়, ভাবনায় ও ভাবে অসংখ্য অসংগতি রয়েছে। আর এইসব অসংগতি প্রহসনকার স্বেচ্ছায় রূপায়িত করেছেন। কারণ তিনি পূর্ণাঙ্গ -কোন সামাজিক নাটক রচনা করতে বসেননি—সৃষ্টি করতে চেয়েছেন প্রহসন, এইসব অসংগতিকে প্রদর্শন করে হাস্যরসের অবতারণা করাই যার মূল লক্ষ্য । সে লক্ষ্য তিনি অব্যর্থভাবে ভেদ করতেও পেরেছেন। আর, সেই সাফল্য তাঁর উন্নত প্রতিভারও পরিচায়ক ।