-->

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের প্রকৃতি চেতনা

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক উপন্যাসের প্রকৃতি চেতনা
প্রকৃতি এখানে মুখ্য। মানুষ গৌণ।

   প্রকৃতির মধ্যে অনন্ত তত্ত্ব অভিব্যক্ত। যে অনন্ততত্ত্ব ব্যক্তিদেহে প্রতিভাত হলে ব্যক্তি হয় প্রেমের আস্পদ, আর বস্তুদেহে প্রতিভাত হলে বস্তু হয়ে প্রেমের আলম্বন ভাব। প্রকৃতি একই সঙ্গে ব্যক্তি ও বস্তুকে মেলায়। প্রকৃতি মানুষের কাছে শান্তির আশ্রয়। বিভূতিভূষণের গল্প ও উপন্যাসে প্রকৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি প্রকৃতি প্রেমিক। কবিত্ব ঝরার মানসে তিনি যেমন প্রকৃতির বর্ণনা করেছেন, তেমনি চরিত্রের সঙ্গে সংযোগ সাধনে প্রকৃতিকে প্রচ্ছদপট হিসাবে ব্যবহার করেছেন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভূতিভূষণের জঙ্গলের জীবন অতিবাহিত হয় ভাগলপুরে। জঙ্গলে থাকতে-থাকতে জঙ্গল হয়ে ওঠে তাঁর কাছে ‘আনন্দের ভাণ্ডার’। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারি দিনলিপির পৃষ্ঠায় লিখেছেন—‘এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে একটা কিছু লিখব।’ এক দশক পরে কলকাতায় ফিরে এসে সেই সঙ্কল্প পালন করে রচনা করেন ‘এক অভিনব উপনিষদ’ ‘আরণ্যক’।

‘আরণ্যক' উপন্যাসের বিস্তৃত পটভূমিকায় অরণ্য প্রাধান্য লাভ করেছে। সেই অরণ্যের কোলে স্থান নিয়েছে পশু-পাখি ছায়া ঘন নিবিড় অরণ্যভূমি, নানারকম পশু-পাখির গর্জন, পাখিদের কলকাকলি, মায়াঘন জ্যোৎস্না। এসব মিলনেই অরণ্যের অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তা। সেই রহস্যময়তার মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করেছে অরণ্য আশ্রিত মানুষগুলি। অনার্য সাঁওতাল রাজা দোবরু পান্নার সরলতা, আতিথেয়তা, অন্তরঙ্গতা অরণ্যের মতই সহজ ও নির্মল। মহাজন ধাওতাল সাহুর অর্থ থাকলেও অর্থসর্বস্ব তিনি নন। লক্ষপতি ধাওতাল সাহুর অরণ্যের মাঝে বসে নোংরা উড়ানির প্রান্তে কলাইয়ের ছাতুখান অবলীলায়। অরণ্যের মত সরল তার মন। জীবনের জটিলতা কোনোভাবে তাকে স্পর্শ করেনি। পনেরো-ষোলো হাজার টাকার দলিল তামাদি হয়ে গেলেও বিন্দুমাত্র তিনি চিন্তা করেন ঋণ আদায় না করতে পারার জন্য মনে তার কোনো ক্ষোভ নেই। কবি বেঙ্কটশ্বরের কবিতা অন্তপ্রাণ। ধাতুরিয়া নাচে ও গান গায়। আর তার বিনিময়ে সে শুধু চিনাঘাসের দানা আর নুন পেলেই সন্তুষ্ট হয়। সত্যচরণ তাকে চাষের জমি দিলে সে বলে—“চাষের কাজ কী আমাকে দিয়ে হবে? ওদিকে আমার মন নেই যে! নাচ দেখাতে পেলে মনটা ভারী খুশী থাকে। আর কিছু তেমন ভালো লাগে না।’’ আধুনিক জীবনের ছলা-কলা এরা জানে না, অরণ্যের মতই এরা আদিম। অরণ্যের মতই এরা উচ্ছ্বল ও চঞ্চল।

রাজু পাঁড়ে ঘরে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি তৈরি করে পুজো করে, বই পড়ে, তৈজস পত্র না থাকায় কাঁচা শালপাতার সিদ্ধ রচনা চিনা বাজ খায়, তবু চাষবাসে মন দেয় না। অরণ্যপ্রেমিক যুগলপ্রসাদ কোনো স্বার্থ ছাড়া অরণ্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দিবা-রাত্রি পরিশ্রম করে যান। যুগলপ্রসাদ বলেছেন, ‘যেখানে যে ফুল নেই, সেখানে সেই ফুল, গাছ লতা নিয়ে পুঁতব এ আমার শখ। সারাজীবন ওই করে ঘুরেছি।’ টোলের পণ্ডিত মটুকনাথ, ষাট বছরের বৃদ্ধ নাচিয়ে দশরথ, এক জোড়া মোষ পেলে গনু মাহাতো স্বপ্ন অরণ্য জীবনেই খাপ খায়। ভানুমতী, কুম্ভা, মঞ্চী, ধ্রুবা, সহায় সম্বলহীন রাখালবাবুর বিধবা পত্নীকে এমন অরণ্যের পরিবেশেই যথাযথভাবে মানিয়ে যায়। দোবরু পান্নার নাতির মেয়ে ভানুমতী বনের হরিণীর মত চটুলা, মর্যাদা জ্ঞানে বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই, সত্যচরণের সঙ্গে পাহাড়ে উঠতে সঙ্কোচ নেই। সত্যচরণ বলেছেন—‘‘...অরণ্যানী মেঘমালা শৈলশ্রেণী যেমন মুক্ত ও স্বাচ্ছন্দ্য। ভানুমতীর ব্যবহারও তেমনি সংকোচহীন, সরল বাধাহীন।’’ ভানুমতীকে নিয়ে অরণ্যের পরিবেশে সত্যচরণ র‍্যোমান্টিক স্বপ্ন বুনেছেন—‘এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম। ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম।’ কুম্ভা বাঈজী বন্যা হলেও তার চরিত্রে কোথাও এতটুকু কলঙ্কের কালি লাগেনি। রাতের অন্ধকারে ক্ষেত থেকে ধান ও মকাই কুড়িয়ে আনে। সন্তানদের জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করে সে। রাসবিহারী সিং তার দেহ ভোগের বাসনায় লোভ দেখিয়ে নিয়ে গেছে, ছোরা তুলে ভয় দেখিয়েছে, কুম্ভা বলেছে—‘মেরে ফেল বাবুজী, জান দেগা, ধরম দেগা নেহি।’ কুম্ভার সেবায় সুস্থ হয় গিরিধারীলাল। নকছেদীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মঞ্চীর সারল্য আকর্ষণ করেছিল সত্যচরণকে। ফসল কাটুনী মজুর মঞ্চীর মুখ থেকে সত্যচরণ তা ভবঘুরে জীবনের আখ্যান শুনেছে। বসন্তরোগে সন্তানকে হারাবার পর মঞ্চীও হারিয়ে গেছে। সে নকছেদীর কিশোরী মেয়ে সুরতিয়ার সঙ্গে পাখি শিকারের আনন্দ উপভোগ করেছেন সত্যচরণ। পণ দিতে না পারার জন্য বিয়ে হয়নি ধ্রুবার। ধ্রুবার দাদা বাঙালি পাত্র পেলে তিন বোনকে এক পাত্রে সম্প্রদান করতে চেয়েছিলেন, ধ্রুবাদেরও তাতে কোনোরকম অমত ছিল না। কিন্তু বিবাহ হয়নি ধ্রুবার। যৌবনকে ব্যর্থ করে দিবারাত্রি সে পরিশ্রম করেছে। রাসবিহারী সিং, দেবী সিং, ছটু সিংকে বাদ দিলে উপন্যাসের সমস্ত চরিত্র অরণ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

সত্যচরণের অরণ্যমুগ্ধতাকে বিকশিত করেছে এইসব চরিত্ররা। ডায়েরীর পৃষ্ঠায়, বিভূতিভূষণ জানিয়েছেন ‘আমি বৈকাল ভালোবাসি বড়ো আর ভালোবাসি জ্যোৎস্নারাত।’ ‘আরণ্যক’-এ বিকালের কথা, জ্যোৎস্নার কথা এসেছে বারেবারে। প্রকৃতি মুগ্ধতায় আমরা বিভোর হই বটে, কিন্তু সেই বিভোরতার মধ্যেও আমাদের মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে এইসব চরিত্ররা। দরিদ্র অরণ্যচারী মানুষগুলোই অরণ্যের প্রাণকে আবিষ্কার করে দিয়েছে। নির্জন জ্যোৎস্নারাত্রি কিম্বা দাবানলের অগ্নিবর্ষণের সঙ্গে দরিদ্র এইসব মানুষগুলোর জীবন মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে। আকাশ, জ্যোৎস্না, মেঘ, পুষ্প, পাখির কাকলি, ভানুমতী, মঞ্চী ধাতুরিয়া—এইসবের মাঝে সত্যচরণ এক অসীম সত্তা তথা বৃহৎ হার্মনিকে আবিষ্কার করেছেন।

‘আরণ্যেকে’র চরিত্রগুলো সব মিলিয়ে প্রকৃতিরই এক সংস্করণ বলা চলে। বন্য প্রকৃতির মতোই তাদের স্বভাবজাত সৌন্দর্য বিকশিত হয়েছে। তাই কখনই আমরা বলতে পারি না, প্রকৃতির অতিপ্রভাব মানবজীবনের স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায় হয়েছে। অরণ্য আর অরণ্যের পুত্রকন্যাদের নিয়েই এই উপন্যাসের সম্পূর্ণতা। ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের প্রকৃতি আমাদের মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করলেও প্রকৃতি এখানে মুখ্য, মানুষ গৌণ একথা কখনই বলা যায় না।