সংস্কৃত গীতিকাব্য || সংস্কৃত গীতিকাব্যের শ্রেণি বিভাগ || সংস্কৃত সাহিত্যের সার্থক গীতিকাব্য 'মেঘদূতম্' সংক্ষিপ্ত পরিচয়
সংস্কৃত গীতিকাব্য:
অধ্যাপক ম্যাকডোনেল বলেছেন যে, সংস্কৃতে কতকগুলি ‘লিরিক' কাব্য আছে, যা বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লিরিক কবিতাগুলির সমপর্যায়ভুক্ত। এই লিরিক (Lyric) শব্দের দ্বারা গীতিকাব্যকেই বোঝানো হয়ে থাকে। ইংরেজি Lyre অর্থাৎ বীণাজাতীয় বাদ্যযন্ত্র থেকে শব্দটি উৎপন্ন। সাহিত্য দর্পণকার বিশ্বনাথ এই জাতীয় কাব্যের নাম দিয়েছেন খণ্ডকাব্য। “খণ্ডকাব্যং ভবেৎ কাব্যস্যৈকদেশানুসারি চ।” এই জাতীয় কবিতায় কবি তার চিন্তা ও অনুভূতির প্রেরণা নিয়ে আপন সৃষ্টির মধ্যে ধরা দিয়ে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় – “যে গান কানে যায় না শোনা সে গান যেথায় নিত্য বাজে।” সুতরাং, কবির স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়াবেগ - তা প্রেমের, বিরহের বা ভক্তির যাই হোক-না-কেন, যখন গীতিময় কাব্যরূপ লাভ করে তখনই তা গীতিকাব্যের পদবি লাভ করে। ইংরেজি Lyric থেকে সংস্কৃত গীতিকাব্য বা খণ্ডকাব্যের ব্যাপকতা অনেক বেশি।
গীতিকাব্যের শ্রেণিবিভাগ:
সংস্কৃত গীতিকাব্যের দুটি প্রধান ধারা –
(১) শৃঙ্গার প্রধান (Erotic) গীতিকাব্য – কালিদাসের মেঘদূত।
(২) ভগবদ্ভক্তি প্রধান (Devotional) গীতিকাব্য – জয়দেবের গীতগোবিন্দ।
আবার অনেকে গীতিকাব্যকে চারটি বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যেমন –
(ক) লৌকিক প্রেমমূলক (মানব-মানবীর প্রেম/Erotic) – দূতকাব্য যেমন – কালিদাসের মেঘদূতম, শতককাব্য যেমন – কালিদাসের শৃঙ্গারশতক ও ঋতুসংহারম, ঘটকর্পরের নীতিসার বা ঘটকপরিকাব্য, বিলহনের চৌরপঞ্চাশিকা, গোবর্ধনের আৰ্যসপ্তশতী প্রভৃতি।
(খ) ভগবৎ প্রেমমূলক – ভর্তৃহরির বৈরাগ্যশতক, ময়ূরকবির সূৰ্য্যশতক, বাণভট্টের চণ্ডীশতক, বিল্বমঙ্গলের কৃষকর্ণামৃত, জয়দেবের গীতগোবিন্দম, শরণের কৃষকর্ণামৃত, ভগবভক্তিমূলক শতককাব্য, দেশপ্রেমমূলক গীতিকাব্য প্রভৃতি।
(গ) নীতিমূলক – ভর্তৃহরির নীতিশতক, অল্পয়দীক্ষিতের বৈরাগ্যশতক, গুমানিকবির উপদেশশতক, জয়রাজ শর্মার বিবেকশতক, ময়ূরশতক – অজ্ঞাতকবি, ক্ষেমেন্দ্রের ছয়খানি নীতি বিষয়ক গীতিকাব্য প্রভৃতি।
(ঘ) সংগ্ৰহাত্মক - কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়, শম্ভুপণ্ডিতের অন্যোক্তিমুক্তালতাশতক, বটুদাসের পুত্র শ্রীধরদাসের সদুক্তি কর্ণামৃত, জহ্লনের সুভাষিত মুক্তাবলি, শাঙ্গধরের শাঙ্গধরপদ্ধতি সংকলন, শ্রীধরের সুভাষিতাবলি প্রভৃতি।
সংস্কৃত সার্থক গীতিকাব্য ‘মেঘদূতের’ সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
‘মেঘদূতম্’ মহাকবি কালিদাসের অপরা সৃষ্টি গীতিকাব্যের অপূর্ব আলেখ্য। কবিচিত্তের নব বিরহবেদনা যেন ভাষায় মূর্ত হয়ে উঠেছে এই কাব্যে। মন্দাক্রান্তা ছন্দে লেখা শতাধিক পদ্যে রচিত প্রেমমূলক কাব্যটি পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ নামে দুটি অংশে বিভক্ত। মেঘদূত কালিদাসের তথা সংস্কৃত সাহিত্যের একখানি অভিনব কাব্য। আত্মভাবনাময় এমন অপূর্ব গীতিকাব্য সংস্কৃত সাহিত্যে এর আগে ছিল না, আর হবেও না। এই কাব্যে বিরহী যক্ষের আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ অনুভূতির স্পর্শ খুব তীব্র। এই কাব্যে কালিদাসের প্রেমচেতনা কেবল সম্ভোগের সঙ্গে যুক্ত নয়, প্রেম সম্পর্কে কবির হৃদয়ে যে একটা পূর্ণতার আদর্শ ছিল, মেঘদূতম সেই আদর্শের স্বরূপ। প্রেমোন্মত্ত অভিশপ্ত নায়কের বিরহবেদনা ও পুঞ্জীভূত শোক, মন্দাক্রান্তা ছন্দের বিলম্বিত তালে বিশ্বব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে। দেশে-বিদেশে নানা ভাষায় এই কাব্যটি অনূদিত হয়েছে। মহাকবি গ্যেটে অনূদিত কাব্য পাঠ করে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসাসূচক একটি কবিতা রচনা করেন।
মেঘদূতম কাব্যের প্রকৃতিচেতনাও প্রশংসার দাবি রাখে। প্রকৃতি এখানে সচেতন স্পর্শকাতর। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে একটা নিবিড় অন্তরঙ্গ যোগ রয়েছে কালিদাস তা সহৃদয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। বিরহী যক্ষের বিরহবেদনার তীব্রতা এবং বিরহিণীর সুগভীর আর্তি মহাকবি নিজের অনুভব দিয়ে নিখিল মানব-মানবীর শাশ্বত বিরহরূপে কল্পনার রঙে চিত্রিত করেছেন। এই মন্ময়তার স্পর্শে মেঘদূত সার্থক গীতিকাব্য হয়ে উঠেছে। যদি গীতিপ্রবণতা ও আত্মগত ভাবনার দ্বারা বহির্জগৎকে আত্মসাৎ করা গীতিকাব্যের মূল লক্ষ্য হয়, তবে সেদিক দিয়েও ‘মেঘদূত’ প্রকৃত গীতিকাব্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বেদনার ব্যাপ্তি, দুঃখের ঐকান্তিক গভীরতা, প্রিয়ামিলনের ব্যাকুলতা, তন্ময়ীভাবের র্যোমান্টিক আবেগ মেঘদূতকে সর্বকালের সার্থক গীতিকাব্যে পরিণত করেছে।