নাট্যতত্ত্ব / দৃশ্যকাব্য || সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তর
নাট্যতত্ত্ব / দৃশ্যকাব্য:
১. ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রে নাটককে কার অঙ্গ হিসাবে দেখেছেন? তাঁদের মতে নাটক হল কি?
উ: ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রে নাটককে কাব্যেরই একটা অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তাঁদের মতে নাটক হল দৃশ্যকাব্য।
২. নাটক রচয়িতাকে অলংকার শাস্ত্রে কি বলে উল্লেখ করেছেন?
উ: নাটক রচয়িতা ও শ্রব্যকাব্য রচিয়তা উভয়কেই অলংকার শাস্ত্রে কবি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ কবি কর্মই কাব্য।
৩. দৃশ্যকাব্য কাকে বলে? দৃশ্যকাব্যকে কি বলা হয়?
উ: যা অভিনয় যোগ্য অর্থাৎ অভিনীত হতে পারে তা দৃশ্যকাব্য। দৃশ্যকাব্যকে ‘রূপক’ বলা হয়।
৪. দৃশ্যকাব্যকে রূপক বলা হয় কেন?
উ: ‘রূপ্যন্তে অভিনীয়ন্তে ইতি রূপানি নাটকাদীনি’—নাট্যশাস্ত্র সুপ্রাচীন কাল থেকে রূপ ও রূপকনাট্য অর্থেই প্রযুক্ত হয়ে আসছে। রূপ আরোপিত হলেই নাট্যকে রূপক বলা হয়ে থাকে।
৫. আভিনয় কয় প্রকার ও কি কি?
উ: অভিনয় চার প্রকার—ক) আঙ্গিক খ) বাচিক গ)আহার্য ঘ) সাত্ত্বিক।
৬. নাটকে আঙ্গিক বলতে কি বোঝায়?
উ: অঙ্গ দ্বারা প্রদর্শিত আভিনয়কে আঙ্গিক বলে। আঙ্গিক অভিনয় সম্পর্কে আচার্য ভরতমুনি চোখ, ভ্রু, কপাল, চিবুক এবং মুখ প্রভৃতি অঙ্গের উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে মুখের ভঙ্গিমার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
৭. বাচিক অভিনয় কি?
উ: বাচিক অভিনয় আঙ্গিক অভিনয়ের সাথে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই অভিনয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে পাত্র-পাত্রীদের ব্যাকরণ-শাস্তে, কাব্যশাস্ত্র, সঙ্গীত শাস্ত্র এবং ছন্দ শাস্ত্রে দক্ষতা আবশ্যক।
বাচিক অভিনয়ের মুখ্য সংলাপের বিভিন্ন প্রয়োগ বিধি—শুদ্ধ, স্পষ্ট, সমুচিত এবং সন্দর্ভ সম্মত উচ্চারণ বিধি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকলেই বাচিক অভিনয় সুচারুরূপে করা সম্ভব।
৮. আহার্য অভিনয় কি?
উ: আহার্য অভিনয়ে প্রসাধন বেশভূষা সাজ বিশেষজ্ঞ ভাবে আবশ্যক। আচার্য ভরত একে নেপত্য কর্ম আখ্যা দিয়েছেন। দেশকাল জাতি বয়স এবং অবস্থান রূপ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রসাধনে ভূষিত করার বিষয় সম্যক ভাবে প্রয়োগ আবশ্যক।
৯. সাত্ত্বিক অভিনয় কি?
উ: সাত্ত্বিক অভিনয়কে সাক্ষাৎ শিব স্বরূপ অভিনয় আখ্যা দেওয়া হয়েছে। যে নাটকে সাত্ত্বিক অভিনয় মুখ্য হিসাবে প্রতীত হয় তাকে শ্রেষ্ঠ অভিনয় হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
যে নাট্যে ভাবজ ব্যক্তি স্বাত্তিক ভাবের মাধ্যমে নৃত্য প্রদর্শন করে তাই সাত্ত্বিক অভিনয়।
১০. রসভাবের প্রয়োগ নাটকে কার দ্বারা সম্ভব?
উ: রসবেত্তাদের দ্বারা হয়ে থাকে।
১১. নাটকের অভিনয়ে কয় প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ আছে? সেগুলি কি কি?
উ: অভিনয়ে তিন পক্রিয়ার কথা উল্লেখ আছে।
১. শাখা—আঙ্গিক অভিনয়।
২. অঙ্কুর—সুচনাত্মক।
৩. নৃত্য—যুক্তকরণ অবিনয়কে নৃত্য বলে।
১২. দৃশ্যকাব্য কয় প্রকার ও কি কি?
উ: দৃশ্যকাব্য দুই প্রকার।
১) প্রকৃত রূপক।
২) উপরূপক।
১৩. নাট্যশাস্ত্রকারদের মতে বা নাট্যশাস্ত্রানুসারে রূপকের মধ্যে কত প্রকার উপকরণ ও উপরূপকের উল্লেখ আছে?
উ: রূপকের মধ্যে দশ প্রকার উপকরণ বিদ্যমান। ১৮টি উপরূপকের উল্লেখ আছে।
১৪. নাটক শব্দটির ব্যুৎপত্তি করলে কি হয় লেখ?
উ: সংস্কৃত ‘নৃৎ’ ধাতু হতে নৃত্য কথাটি উপন্ন হয়েছে। এর অপর নাম ‘নাট’—হতে নাটক শব্দটির সৃষ্টি।
১৫. নাটকের সৃষ্টির ইতিহাস সংক্ষেপে কি?
উ: চতুর্বেদে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যকোন সম্প্রদায় বা জাতির অধিকার না থাকায় ইন্দ্রের আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা পঞ্চম বেদ বা নাটকের সৃষ্টি করেন। ঋক্বেদ হতে বাণী, সামবেদ হতে গীতি, যজুবেদ হতে অভিনয় এবং অথর্ববেদ হতে রস ও অনুভূতি সংগ্রহ করে পঞ্চমবেদ বা নাটকের সৃষ্টি।
১৬. পূর্ণাঙ্গ নাটকের কি ভাবে জন্ম হল? কে এই নাট্যবেদ প্রথম জগতে প্রচার করেন?
উ: পঞ্চম বেদের সঙ্গে যুক্ত হল মহাদেবের তাণ্ডব, পার্বতীর লাস্য এবং বিষ্ণুর নাট্যরীতি এইভাবে সৃষ্টি হল পূর্ণাঙ্গ নাটকের। ব্রহ্মা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ভরতমুনি এই নাট্যবেদ জগতে প্রচার করেন।
১৭. নাটককে বেদ আখ্যা কে প্রদান করেন? তার লেখা গ্রন্থের নাম কি?
উ: মহামুনি ভরত নাটককে সার্ববর্ণিক বেদ আখ্যা প্রদান করেছেন। তাঁর লেখা গ্রন্থের নাম ‘নাট্যশাস্ত্র’।
১৮. নাটকের নায়ক চরিত্র কেমন হবে?
উ: ভরতমুনির সিদ্ধান্তানুসারে এবং নাট্যকারগণের ব্যবহার বিধি অনুসারে নাটকের নায়ক হবে ধীরোদাত্ত, ধীরোদ্ধত, ধীরললিত এবং ধীরপ্রশান্ত—এই চার প্রকার।
১৯. ‘নাটক্যং খ্যাতবৃত্তং স্যাং পঞ্চসন্ধি সমন্বিতম্’—বিশ্বনাথ কবিরাজের এই উক্তিতে পঞ্চসন্ধি কি কি?
উ: নাটকীয় কথাবস্তুতে পঞ্চসন্ধি সমাবেশ ঘটে। যা হল—মুখ, প্রতিমুখ, গর্ভ, বিমর্শ, উপসংহৃতি।
২০. মুখ, প্রতিমুখ, গর্ভ, বির্মশ, উপসংহৃতি—নাটকের কোন কোন অংশকে বোঝান হয়?
উ: মুখ - বীজ তথা আরম্ভ মিলে মুখসন্ধি।
প্রতিমুখ – বিন্দু তথা প্রযত্ন মিলে প্রতিমুখ।
গর্ভ- নাটকের পতাকা তথা প্রত্যাশা মিলে গর্ভ।
বির্মশ – গর্ভের প্রকরী থতা নিয়তাপ্তি মিলে বিমর্শ।
উপসংহৃতি – কার্য তথা ফলাগম মিলে উপসংহৃতি বা নির্বহন সন্ধি।
২১. কথাসূত্র কয়প্রকার ও কি কি?
উ: কথাসূত্র দুই প্রকার। যথা—দৃশ্য, সুচ্য।
দৃশ্য—কথাসূত্র মঞ্চে দেখানো হয়ে থাকে।
সূচ্য—কথাসূত্র পাত্রের সংবাদ এর দ্বারা সূচনা মাত্র করা হয়। ককণো কখনো সূচ্য কথা সূত্র নেপথ্যে প্রকাশ পায়।
২২. অর্থোপক্ষেপক কি? এটি কয় প্রকার ও কি কি?
উ: কথাসূত্রের সূচনা প্রকারকে অর্থোপক্ষেপক বলা হয়। এর দ্বারা অঙ্কের অদর্শনীয় বস্তু সূচিত হয়। অর্থোপক্ষেপক পাঁচ প্রকার।
যথা— ১) বিষ্কম্ভক
২) প্রবেশক
৩) চূলিকা
৪) অংকাস্য
৫) অংকাবতার।
২৩. নাট্যসাহিত্যে নায়িকার ভেদ কয় প্রকার ও কি কি?
উ: অবস্থা অনুষারে নায়িকার তিন ভেদ দেখা যায়।
১) মুগ্ধা।
২) মধ্যা (তিন প্রকার—ধীরা, অধীরা, ধীরাধীরা)
৩) প্রগল্ভা (তিন প্রকার—ধীরা, অধীরা, ধীরাধীরা)
২৪. নাট্যশাস্ত্রে নায়কের সাথে সম্পর্ক যুক্ত নিয়িকার ভেদ কয়প্রকার ও কি কি?
উ: নায়কের সাথে সম্পর্কযুক্ত নায়িকা ভেদও তিন প্রকার।
১) স্বীয়া।
২) অন্যা।
৩) সামান্যা।
২৫. নাট্যে রস যোজনা সম্পর্কে ভরত মুনি কি বলেছেন?
উ: ভরতমুনি বলেছেন—‘বিভাবানুভাবভ্যভিচারি সংযোগাদরসনিষ্পত্তিঃ।’
২৬. ‘যতো হস্তস্ততো দৃষ্টিযত্বো দৃষ্টি স্ততোমনঃ
যতো মনস্ততো ভাবো যতোভাবস্ততো রসঃ।।’
—উক্তিটি কে কোন গ্রন্থে বলেছেন? শ্লোকটির ব্যাখ্যা কর।
উ: আচার্য নন্দিকেশ্বর তাঁর অভিনব দর্পণে উক্ত কথাটি বলেছেন।
কথাটির সরল অর্থ কলরে হয়—অভিনয়ে রসানুভূতির নিমিত্ত হাত, দৃষ্টি, মন এবং ভাবের তারতম্যের উপর বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতে হবে।
২৭. রূপক কয় প্রকার ও কি কি?
উ: রূপক দশ প্রকার। যথা—নাটক, প্রকরণ, ভান, ব্যায়োগ, সমবকার, ডিম, বীথী, প্রহসন, ঈহামৃগ, অঙ্কমুখ।
২৮. নাটকের মুখ্য রস কি? নাটকের অঙ্ক সংখ্যা কত হবে?
উ: শৃঙ্গার বা বীর রস।
নাটকের অঙ্কসংখ্যা হবে পাঁচ অঙ্কের বেশি এবং দশ অঙ্কের কম।
২৯. নাটকের কয়টি সন্ধি থাকে?
উ: পাঁচটি সন্ধি থাকে।
৩০. নাটকে নায়ক কয় প্রকার হয়?
উ: নাটকে নায়ক তিন প্রকারের হয়। দিব্য, অদিব্য, দিব্যাদিব্য।
দিব্য নায়কের উদাহরণ হল—শ্রীকৃষ্ণ।
অদিব্য নায়কের উদাহরণ হল—দুষ্যন্ত।
দিব্যাদিব্যের নায়কের উদাহরণ হল—উত্তররাম চরিতে রামচন্দ্র।