ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আয়োজিত নলহাটির সাহিত্য সভায় অতুল গুপ্ত সেই সভার সভাপতি তারাশঙ্করের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন—‘বঙ্গ সরস্বতীর খাস তালুকের মণ্ডল প্রজা’ এই উক্তি যথার্থ। কেননা শরৎচন্দ্র পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাদের অস্থির, সংশয়-বিক্ষুব্ধ-অবিশ্বাসী যুগের প্রধান কথাশিল্পী। রবীন্দ্রোত্তর পর্বে তারাশঙ্কর একজন যথার্থ শিল্পী। তিনি ৪৫ বৎসর ধরে কথাসাহিত্যে পদচারণা করেছেন। এই অর্ধশতাব্দীর সমস্ত তরঙ্গ বিক্ষোভ তারাশঙ্করের গল্প-উপন্যাসকে স্পর্শ করেছে কিন্তু সমকালীনতার গণ্ডী অতিক্রম করে লেখক হয়ে উঠেছেন সর্বকালের। তারাশঙ্কর মনে করতেন—মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। এই ঘোষণা তার উপন্যাস, ছোটগল্পে রক্ত-মাংস-মজ্জা, তাঁর মন-প্রাণ-আত্মা, তাঁর শিল্পের দলিল। এককথায় সুস্থ জীবনের মৌরসীপাট্টা। রাঢ় বাংলার চলমান জীবনের বিশ্বস্ত রূপকার তারাশঙ্কর তাই কালান্তরের কথাকার।
কল্লোল পর্বের তরুণ লেখকদের রচনায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সংশয় ও অস্থিরতা, চাঞ্চল্য ও নাগরিক মনোভাব, নেতিবাদী ও নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি থেকে এক নিবিড় জীবন প্রত্যয়ে সরে এসেছিলেন তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণ। তারাশঙ্কর তাঁর জীবনে দেখেছেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, অহিংস আন্দোলন, সাম্যবাদী আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ৪২-এর সংগ্রাম, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও দেশবিভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন এবং পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। সেই সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, মন্বন্তর, উদ্বাস্তু সমস্যা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং নীতিবোধের পশ্চাদপসরণ। তারাশঙ্করের মানসিকতা এই পটভূমিতে গড়ে উঠেছিল। অন্যদিকে তারাশঙ্করের জন্মধাত্রী বীরভূমের লাভপুর গ্রাম তাঁর মানস গঠনে সহায়তা করেছিল। তাঁর নিজের কথায়—লাভপুর গ্রামখানি অদ্ভূত। ...কালের লীলা, কালান্তরের রূপ-মহিমা এখানে এত সুস্পষ্ট যে বিস্ময় না মেনে পারি না। ...১৮৯৮ সালে লাভপুরের সমাজে তখন দুই বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্ব চলেছে। জমিদার প্রধান গ্রাম। ...লাভপুর সমাজের নেতৃত্বের আসন নিয়ে এই বিচিত্র বিরোধ সমাজ-জীবনের নানা স্তরে বিস্তৃত হয়েছে। কীর্তির প্রতিযোগিতা চলছে মহাসমারোহে প্রকাশের মধ্যে, দ্বন্দ্ব চলছে সৌজন্য প্রকাশ নিয়ে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে রাজভক্তি নিয়ে, প্রতিযোগিতা চলছে জ্ঞানমার্গের অধিকার নিয়ে, আবার পরস্পরের মধ্যে কলংক কালি ছিটানো নিয়েও চলেছে জমিদার ব্যবসায়ীর মধ্যে বিচিত্র বিরোধ। (‘আমার কালের কথা’)
তারাশঙ্করের দেশ-কাল-চেতনাটি ছিল ঐকান্তিক—তাঁর জীবনবোধ এবং জীবনবিন্যাসে তাই মহাকাব্যের ব্যাপ্তি এবং অমোঘতা। বীরভূম জেলার ব্রাহ্মণ জমিদার চালিত গ্রামে ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারে জন্মে গ্রামজোড়া, তথা পরিপার্শ্বগত দরিদ্র-অশিক্ষিত আদিবাসী মানুষের জীবনের সঙ্গে খুঁজে পেয়েছিলেন অন্তরের যোগ। আর একদিকে প্রত্যক্ষ করছিলেন, জমিদারি আভিজাত্যের সামাজিক বনিয়াদ ভেঙে গিয়ে চারপাশে গড়ে উঠছিল অর্থগৃধ্নু আত্মসর্বস্ব ধনতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থা—সমাজ ভেঙেই যার জন্ম। সেই সঙ্গে শিল্পী আকৃষ্ট হয়েছিলেন গান্ধীপন্থী আন্দোলনে। সমাজে আর্থ-রাজনৈতিক বিপত্তির ঐতিহাসিক তরঙ্গটির সঙ্গেও যোগ তাঁর ছিল আন্তরিক। প্রধানত গ্রামজীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অমেয় পুঁজির সংযোগে গল্প-উপন্যাসের থীম গড়েছেন তারাশঙ্কর। তার সঙ্গে কালের ওঠাপড়াকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিয়ে জীবনের একটা পরিব্যাপ্ত সামগ্রিক রূপ গড়ে তুলতে চেয়েছেন উপন্যাসে এবং গল্পেও। সেই জন্যেই গল্পগুলো সঠিক ছোটগল্প হয়ে উঠেনি—উপন্যাসে ধরতে চেয়েছে মহাকাব্যের অবয়ব। রূপের নিটোলতায় না হোক, জীবন সংবেদনের অমোঘতায় তারাশঙ্কর তার কালের শ্রেষ্ঠ উত্তীর্ণ শিল্পী; আর সে-জীবন একান্তভাবে বীরভূমের শিল্পী-পরিচিত আঞ্চলিক জীবন।
অচিন্ত সেনগুপ্ত বলেছেন, তাঁর সাহিত্যের দুই প্রধান উপজীব্য মাটি আর মানুষ। মাটির মমত্ব আর মানুষের মহিমা। একথা যথার্থ। প্রসঙ্গত বলা যায়, চল্লিশের যুগে সমাজকে ব্যাপক এবং সমগ্ররূপে দেখার প্রবণতা আামাদের সাহিত্যে যেমন দেখা যেতে থাকে, তেমন আসে সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের ঘটনা পর্যায়কে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কার্যকারণ সূত্রের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা। তারাশঙ্কর এই কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন, কিছুটা সাফল্যও দেখিয়েছিলেন। তারাশঙ্করের আর একটা বড় কৃতিত্ব, বাংলা সাহিত্যের পরিধি সম্প্রসারণে। রবীন্দ্রনাথ গল্পগুচ্ছে বাঙালি সমাজের থেকে চরিত্র ও ঘটনাগত উপাদান সংগ্রহের কৃতিত্ব দেখালেও তার পরিমাণ সীমিত, শরৎচন্দ্র সেক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারাশংকর যেভাবে ও যতটুকু বাঙালির সমাজ জীবনকে, জীবনের অন্তর্গত চরিত্রকে সাহিত্যরূপ দানের চেষ্টা করেছেন, তার তুলনা নেই।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের অস্থির সংশয়, বিক্ষুব্ধ অবিশ্বাসী যুগের প্রধান কথাশিল্পী। তিনি যে সময়ের শিল্পী সে সময় পুরানো বিশ্বাস ও মূল্যবোধের অবসানের সময়। এই অর্ধশতাব্দীর সমস্ত তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ অবসান ঘটছিল, উদ্ভব হচ্ছিল নতুন বিশ্বাস ও মূল্য বোধের। এই অর্ধশতাব্দীর সমস্ত তরঙ্গ বিক্ষোভ তারাশঙ্করের গল্প উপন্যাসকে স্পর্শ করেছে। তারাশঙ্কর দেখেছেন দুটি দিক–একদিকে সচ্ছল জমিদারী, বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র, প্রাচীনকালের শিক্ষা ও অভিজাত সম্পন্ন পরিবার অন্যদিকে সমগ্র ভারতে সম্প্রসারিত কয়লার ব্যবসায়ে প্রচুর অর্থ সম্পন্ন ধনী পরিবার। তিনি এই দুই শ্রেণীর কোনটিকেই শেষ পর্যন্ত বড় করে তুলে ধরেন নি। তার মতে মানুষের লক্ষ্য জীবন-মুক্তি-ভয় থেকে, হীনতা থেকে, দীনতা থেকে মুক্তি। তার লক্ষ্য নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক, শূন্যতাবাদ নয়, আস্তিক্যবোধ।
তার উপন্যাসের পটভূমি অনেক ব্যাপক, বিস্তীর্ণ। শরৎচন্দ্র ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে যে চিত্র এঁকেছেন তাকে ছাড়িয়ে গেছেন তারাশঙ্কর তার ‘পঞ্চগ্রাম’ ও ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে। দেবু ঘোষ এই দুই উপন্যাসের নায়ক বটে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে পরিবর্তনশীল গ্রামীণ সমাজই নায়ক। এখানেই তারাশঙ্কর যথার্থ আধুনিক জীবনশিল্পী, যুগের রূপকার ।
উপন্যাস :
তারাশঙ্কর উপন্যাস লিখেছেন- প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এবং তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা ষাট । তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এবং শেষ উপন্যাস ‘নবদিগন্ত’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের তালিকা নিম্নে দেওয়া হল : চৈতালী ঘূর্ণি (১৯৩১), পাষাণপুরী (১৯৩৩), নীলকণ্ঠ (১৯৩৩), রাইকমল (১৯৩৪), প্রেম ও প্রয়োজন (১৯৩৫), আগুন (১৯৩৭), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪২), মন্বন্তর (১৯৪৪), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), কবি (১৯৪৪), সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬), ঝড় ও ঝরাপাতা (১৯৪৬), অভিযান (১৯৪৬), হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), পদচিহ্ন (১৯৫০), উত্তরায়ণ (১৯৫০), তামস তমস্যা (১৯৫২), নাগিনী কন্যার কাহিনী (১৯৫২), বিচিত্র (১৯৫৩), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩), চাপাতাঙ্গার বৌ (১৯৫৪), পঞ্চপুত্তলী (১৯৫৬), বিচারক (১৯৫৭), সপ্তপদী (১৯৫৭), বিপাশা (১৯৫৮), রাধা (১৯৫৮), ডাকহরকরা (১৯৫৮), মহাশ্বেতা (১৯৬০), যোগভ্রষ্ট (১৯৬০), না (১৯৬০), নাগরিক (১৯৬০), নিশিপদ্ম (১৯৬২), যতিভঙ্গ (১৯৬২), কান্না (১৯৬২), কালবৈশাখী (১৯৬৩), একটি চড়ুই পাখী ও কালো মেয়ে (১৯৬৩), জঙ্গলগড় (১৯৬৪), মঞ্জরী অপেরা (১৯৬৪), সংকেত (১৯৬৪), ভুবনপুরের হাট (১৯৬৪), বসন্তরাগ (১৯৬৪), গন্না বেগম (১৯৬৫), অরণ্যবহ্নি (১৯৬৬), হীরা পান্না (১৯৬৬), মহানগরী (১৯৬৬), গুরুদক্ষিণা (১৯৬৬), শুকসারী কথা (১৯৬৭), কীর্তিহাটের কড়চা (১৯৬৭), মণি বউদি (১৯৬৭), শক্করী বাই (১৯৬৭), স্বর্গমর্ত (১৯৬৮), ছায়াপথ (১৯৬৯), কালরাত্রি (১৯৭০), অভিনেত্রী (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১) ইত্যাদি।
তারাশঙ্কর চল্লিশ বছর ধরে প্রায় ষাটটি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসগুলিকে পাঁচটি পর্বে বিন্যস্ত করা যায় : প্রথম পর্বের মূল বৈশিষ্ট্য হল—রাজনৈতিক বন্ধন মুক্তির ব্যাকুলতা এবং বৈষ্ণবী নায়িকার মুক্তি সন্ধান। দ্বিতীয় পর্বের উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘কালিন্দী’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘কবি’ ইত্যাদি। তৃতীয় পর্বে ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ থেকেই তারাশঙ্করের উপন্যাস নতুন পথ পরিক্রমা করেছে। আঞ্চলিক উপন্যাসের সার্থক রূপ এখানে লক্ষ করা যায়। সমগ্র মানুষ, সজীব প্রকৃতি এবং সমাজ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল—’নাগিনী কন্যার কাহিনী’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘বিচারক’, ‘সপ্তপদী’ ইত্যাদি। চতুর্থ পর্বের অন্যতম উপন্যাসগুলি হল— ‘মহাশ্বেতা’, ‘যোগভ্রষ্ট’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ ইত্যাদি। এইসব উপন্যাসে লেখক অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। উপন্যাসের শেষ পর্বে তারাশঙ্কর চলতি রীতিকে ভেঙেছেন ।
বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাসেই মানবচরিত্র ও প্রকৃতির অঙ্গাঙ্গী যোগ ঘটেছে। ভৌগোলিক সত্তা এখানে পটভূমি নয়, স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে দেখা দিয়েছে। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে কিছু কিছু আঞ্চলিকতার উপাদান থাকলেও ‘কবি’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ এবং ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’তেই এই আঞ্চলিক চেতনা সর্বাধিক বিকাশ লাভ করেছে। তারাশঙ্করের জনপ্রিয়তার একমাত্র কারণ হল বাংলার আঞ্চলিক জীবনের ব্যাপক চিত্রণ। আঞ্চলিক আখ্যানকে ইনিই সর্বপ্রথম সর্বাঙ্গীণ সাহিত্যের মহিমায় মণ্ডিত করে তুললেন। রাঢ় অঞ্চলের বিচিত্র পরিবেশের মধ্যেই তারাশঙ্করের শৈশব, বাল্য এবং কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছিল এই আঞ্চলিক পরিবেশ তার সত্তার, তাঁর সমগ্র চেতনায় অবিচ্ছেদ্য ভাবেই জড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর চারপাশের ভূ-প্রকৃতি, বিচিত্র জনজীবন এবং তার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল জীবন্ত প্রত্যক্ষরূপে তাঁর সাহিত্যে এসে উপস্থিত হয়েছে। ফলে তিনি হয়েছেন আঞ্চলিক জীবনের অন্তরঙ্গ রূপনির্মাতা। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসে তিনি বোধ হয় পটভূমির একটি বৈশিষ্ট্যকে বাদ দেননি। তাঁর কথায় “চলচ্চিত্র না হইলে প্রতিমা মানায় না, স্থান ও কালের পটভূমি উপযোগী না হইলে পাত্রপাত্রীর পূর্ণ অভিব্যক্তি হয় না। পাঠকেরও কষ্ট হয়।” এই মূল উদ্দেশ্যই লেখকের শিল্প স্বীকৃতির মূল বনিয়াদ। তাঁর আঞ্চলিক উপন্যাসে যে নর-নারীর চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে ঐ বিশেষ আঞ্চলিক জীবনের পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের অন্য কোন স্থানে স্থাপন করা সম্ভব নয় ।
তাঁর আঞ্চলিক উপন্যাসের উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ (১৯৪৭)। এই উপন্যাসের প্রকৃতি কাহিনির দিগন্ত ঘিরে আছে, কোপাই দহের বেড় দিয়ে ঘেরা কাহারদের গ্রামের সঙ্গে প্রকৃতির যোগ নিবিড় ও অন্তরঙ্গ। প্রকৃতির পরিবেশে বদ্ধমূল অ-প্রাকৃতিক সংস্কার, যুগ-যুগ প্রচলিত কিংবদন্তী ও লোককল্পনা উপন্যাসটিকে এক অনন্য মর্যাদা দিয়েছে। শিমুল, বেলবন, শ্যাওড়া বন, চন্দ্রবোড়া সাপ—সব কিছুতেই দেবত্বের আরোপ করা হয়েছে। অন্ত্যজ নরগোষ্ঠীর লৌকিক ও অ-প্রাকৃতিক সংস্কার ও বিশ্বাস এক গোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। বীরভূমের উদাসীন প্রকৃতিই এখানে প্রতীকী রূপ পেয়েছে ‘কর্তাবাবা’ ও কালারুদ্দুরের চরিত্রে। কাহারদের সমাজব্যবস্থাও এই প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। গোষ্ঠীপতির নেতৃত্বের দায়িত্ব, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রাকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা ও প্রবল হৃদয়াবেগের অনিবার্য লীলা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, অন্তঃসঙ্গতি নিবিড় আঞ্চলিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্র রচনা করেছে, এই সমাজে যূথপতি বনোয়ারী লালের কথাই শেষ কথা। এখানে পাখী ও করালীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ন্ত্রিত। ‘বাবা কালারুদ্দুর’ এই গোষ্ঠীর নিয়ন্তা, তাঁর ক্রোধে বিনষ্ট কৃপার জীবনরক্ষা। কোপাইয়ের দহ, বাঁধ, বেলগাছ, বাঁশঝাড়, শিমুল ও শ্যাওড়া বন, অতীতের বন্যা, বর্তমানের যুদ্ধ সবকিছুই কাহার গোষ্ঠীর জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই সবের মধ্য দিয়ে লেখক আদিম জীবনের বেধও উপস্থিত করেছেন, অপরপক্ষে নূতন কালের অনিবার্য পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়ে বাস্তববোধ ও সামগ্রিক জীবনবোধের পরিচয় দিয়েছেন। সব মিলিয়ে যে বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে তা আঞ্চলিক উপন্যাসের যথার্থ পটভূমি ।
তারাশঙ্কর শুধু শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক নন, বিশ শতকের প্রথমার্ধে পশ্চিমবাংলার রাঢ় অঞ্চলের গ্রাম জীবন ও তার জটিল আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের রূপকারও তিনি। দ্বিতীয়ত, আজকের দিনেও তার গুরুত্বের কারণ তার সমাজ দর্শন বা লেখনরীতির গুরুত্বের মধ্যে পাওয়া যাবে না, তা পাওয়া যাবে তাঁর কথাসাহিত্য জগতের বিশালতায়, বিষয় নির্বাচনে, গ্রামীণ শ্রেণিবিভক্ত সমাজের ভাঙ্গা-গড়ার চিত্রাঙ্কনের চেষ্টায়। উপন্যাসের পরিধি বাড়িয়ে নীচুতলার মানুষকে তাতে স্থান দেওয়া এবং তা বই পড়া জ্ঞান দিয়ে নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে—এখানেই তারাশঙ্কর বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রকে পেরিয়ে গেছে।। তৃতীয়ত, তার মতে মানুষের লক্ষ্য শুধু দেশের রাজনৈতিক মুক্তি বা অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, তাঁর লক্ষ্য জীবন মুক্তি—ভয় থেকে, হীনতা থেকে, দীনতা থেকে মুক্তি। তাঁর লক্ষ্য তাই নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক; শূন্যতাবাদ নয়, আস্তিক্যবোধ। চতুর্থত, তিনি তাঁর সাহিত্য সাধনায় খুঁজেছেন এক সমগ্র অখণ্ড মানুষকে, মানুষ ও প্রকৃতিকে, মাটির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে। বর্তমান সমাজে ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি থেকে ছিন্নমূল জীবনের বিচ্যুত এক ক্ষেত্রে তারাশঙ্করের চিন্তা ও ভাবনা তথা আস্তিক্যবোধ মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে—একথা ভেবে দেখবার অবকাশ বোধ হয় এসেছে। বলাবাহুল্য তারাশঙ্করের শিল্পীমানস দেশ-কাল-সমাজের পটভূমিকায় বিচিত্র নরনারীর যে চিত্রশালা নির্মাণ করেছেন তা দেশকাল নিরপেক্ষ রূপলাভ করেছে, আর এখানেই কালান্তরের কথাকার তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠত্ব ।