প্রার্থনা পদের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও চৈতন্য উত্তরযুগে প্রার্থনা বিষয়ক পদকর্তা নরোত্তম দাস
প্রার্থনা পদের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য:
সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের চরণে ভক্তের আত্মসমর্পণই হল ‘প্রার্থনা’। নিজ অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ‘প্রার্থনা’ পর্বের পদে মধুর রসের কোন স্থান নেই, ঐশ্বর্য রসের সাধনাই ‘প্রার্থনা’ পর্বে ভক্তের একমাত্র সাধনা। এখানে কৃষ্ণ হলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আর কবি হলেন ভক্ত। সকলের হয়ে কবির প্রার্থনা—
‘‘পাপোহহং পাপকর্মাহং পাপাত্মা পাপসম্ভবঃ।
ত্রহি মাং পুণ্ডরীকাক্ষ সর্ব্বপাপহরো হরি।।’’
প্রার্থনা পর্বে ঐশ্বর্য রসের উপলব্ধি ভগবান কৃষ্ণের প্রতি ভক্ত কবির দেহ মন প্রাণের সর্বৈব নিবেদনই মুখ্য বস্তু। ভগবান কৃষ্ণের কাছে সখ্যভাবে রাধার দেহ মন প্রাণের নিবেদন বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রেম ও পূজা এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। রাধার চরম আত্মনিবেদনই ভাষা পেয়েছে। তাই ‘প্রার্থনা’ ও ‘নিবেদন’—অর্থ ও ভাবব্যঞ্জনা প্রায় কাছাকাছি। বিদ্যাপতির কাছে কবির জবানীতে যা হয়েছে ‘প্রার্থনা’, চণ্ডীদাসের কাছে রাধার জবানীতে তাই হয়েছে ‘নিবেদন’। চৈতন্য পূর্বযুগের কবি বিদ্যাপতি শান্ত রসাশ্রিত প্রার্থনা পদ লিখেছেন। তিনি মুক্তি কামনা করেছেন। কিন্তু চৈতন্য উত্তরযুগের বৈষ্ণব কবি কখনও মুক্তি চান না। রাধা কৃষ্ণের সেবাই তাঁর একান্ত প্রার্থনা।
প্রার্থনা পর্বের পদে বিদ্যাপতির শ্রেষ্ঠত্ব:
চৈতন্য পূর্বযুগের কবি বিদ্যাপতির ‘প্রার্থনা’ পর্বের রচনায় কবির আত্মসমর্পণ চরমতম রূপ পেয়েছে, এখানে সম্পূর্ণভাবে হয়ে উঠেছেন তিনি ভক্ত কবি। যেমন—
“মাধব বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসী তিল এ দেহ সমৰ্পিল
দয়া জনি ছোড়বি মোয় ।।
গণইতে দোষ গুণ-লেশ না পাওবি
যব তুহুঁ করবি বিচার।
তুহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি
জগ বাহির নহ মুঞি ছার।।’
তিল তুলসী দিয়ে কবি নিজেকে কৃষ্ণের চরণে সমর্পণ করে দিয়ে বলেছেন যে তাঁর দোষের শেষ নেই, কৃষ্ণের দয়া ব্যতীত তাঁর উদ্ধারের কোন রাস্তা নেই। ভক্ত হৃদয়ের আন্তরিকতা এখানে গভীর রস সমৃদ্ধ হয়েছে। আসলে কবি বিদ্যাপতি এই পর্যায়ে পদে ইহজীবন থেকে মুক্তি ‘মোক্ষ’ কে-ই খুঁজেছেন। বয়সান্তিক জীবনে কবি কোনো কাঙ্ক্ষিত ধন দৌলত চাননি। একান্তভাবে ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তিল তুলসী দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করেছেন। কবি জানেন তিনি দোষী এবং পাপী। জগৎ সংসারে ভালো কাজ তিনি খুব একটা করেন নি। তবু কবির দৃঢ় বিশ্বাস, দয়াময় প্রভু তাঁকে গ্রহণ করবেন। জীবনের শেষবেলায় কবি সর্বান্তকরণে নিজেকে ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করেছেন। কবির একান্ত আকাঙ্ক্ষা জগতের প্রভুর শ্রীকৃষ্ণ যেন কবিতে তাঁর অসীম করুণা থেকে বঞ্চিত না করেন। ঈশ্বর দীনের বন্ধু। তিনি নিশ্চিত তাঁকে উদ্ধার করবেন, ভক্ত কবি এই আশা করেন। ঈশ্বর চরণরূপ তরী চড়ে কবি উদ্ধার পেতে চেয়েছেন—
ভণয়ে বিদ্যাপতি অতিশয় কাতর
তরইতে ইহ ভবসিন্ধু ।
তুয়া পদপল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু । ।
বিদ্যাপতিকে অনেক সুখের কবি, সম্ভোগের কবি, বিলাস কলার কবি বলে মূল্যায়ন করে থাকে। কিন্তু প্রার্থনা পর্যায়ের পদগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় যে তাঁর হৃদয়ের মধ্যে ভক্তির গভীরতা কত তীব্র ছিল। এই পর্যারের আরেকটি পদ— ‘তাতল সৈকতে বারিবিন্দুসম’ তেও কবির মুক্তিবাঞ্ছা-ই প্রধান হয়ে উঠেছে। সমস্ত জীবন কবি ভোগকাঙ্ক।সায় ব্যাপৃত থেকে ঈশ্বরকে ভুলে ছিলেন। জীবনের শেষবেলায় কবি কণ্ঠে শোনা গেছে অনুশোচনা। পার্থনা পদে সেই অনুভূতিই ব্যক্ত করেছেন কবি। একারণে অধ্যাপক শঙ্করী প্রসাদ বসু বলেছেন, “বিদ্যাপতি সবলে, প্রমত্ত বাসনায় জীবনের কণ্ঠালিঙ্গন করিয়াছিলেন, এক সময় চমকিয়া দেখিলেন—আলিঙ্গনে ধরা আছে সুঠাম দেহের পরিবর্তে শীর্ণ গহ্বরময় কঙ্কাল;—সে কঙ্কালকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া নৈরাশ্যে ভয়ে তিনি কাঁদিয়া উঠিলেন। প্রার্থনার পদে সেই ক্রন্দনমোচন; দেহশ্মশানে দেহজীবন প্রেমের বিলাপ সঙ্গীত।”
চৈতন্য উত্তরযুগে প্রার্থনা বিষয়ক পদকর্তা নরোত্তম দাস:
চৈতন্য উত্তরযুগে নরোত্তমের প্রার্থনা বিষয়ক পদগুলিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মনোভাবই প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যাপতির পদে মুক্তি বা মোক্ষ প্রধান হয়ে উঠেছে। কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা মুক্তির পরিবর্তে রাধাকৃষ্ণের যুগল শ্রীচরণ সেবা করতে চেয়েছেন। নরোত্তমের পদে পাই—
“হরি হরি হেন দিন হইবে আমার ।
দুহুঁ অঙ্গ পরশিব দুহুঁ অঙ্গ নিরখিব
সেবন করিহ দোঁহাকার।।”
তাঁর অপর একটি পদে দেখি, ‘হরি হরি’ বলতে বলতে কবির দুনয়নে বইবে জল ধারা—
“গৌরাঙ্গ বলিতে হৈবে পুলক শরীর
হরি হরি বলিতে নয়নে বহেনীর।
আর করে নিতাই চাঁদ করুণা করিবে
সংসার বাসনা মোর করে শুদ্ধ হইবে।”
ভক্ত কবি এখানে মুক্তি চান নি, সংসার বাসনা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। রাধা-কৃষ্ণের সেবা করে জীবনকে তাঁর ধন্য করে তুলতে চেয়েছেন।