-->

মাথুরের সংজ্ঞা শ্রেণি বিভাগ, মাথুরের আধ্যাত্মিকতা, মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর কৃতিত্ব

মাথুরের সংজ্ঞা শ্রেণি বিভাগ, মাথুরের আধ্যাত্মিকতা, মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর কৃতিত্ব

 মাথুরের সংজ্ঞা:

বৈষ্ণব পদাবলীতে বৈষ্ণব রসতত্ত্বের বিভিন্ন পর্যায়ের যে গীতি উপস্থাপনা আছে তার একটি পর্যায় হল মাথুর। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে মা প্রবাস রূপে অখ্যাত তাই বৈষ্ণব পদাবলীতে চিরবিরহের ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে মাথুরে পরিণত হয়েছে। রূপ গোস্বামী তাঁর ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থে প্রবাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—

 “পূর্বসঙ্গতয়োধুনোৰ্ভ বন্দেশাস্তরাদিভিঃ।

ব্যবধানস্ত যৎ প্রাজ্ঞৈঃ স প্রবাস ইতীর্যতে।।”

অর্থাৎ পূর্ব সম্মিলিত নায়ক-নায়িকা দেশ-গ্রাম-বন ইত্যাদি যে ব্যবধান প্রাজ্ঞঃ গান তাকেই প্রবাস নামে অভিহিত করে থাকে।

মাথুরের প্রকার ভেদ:

প্রবাসকে কালানুসারে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা—১) ভাবি বিরহ , ২) ভবন বিরহ ও ৩) ভূত বিরহ কৃষ্ণ মথুরায় চলে যাবেন এই সংবাদে রাধার মনে তীব্র বিরহের জ্বালা শুরু হয়ে যায়। পূর্ব থেকেই এই যে বিরহের ভাব এটাই হল—ভাব বিরহ। কৃষ্ণ মথুরায় চলে যাবেন রথ সজ্জিত, তিনি গৃহ থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন; এই সময় রাধার মনে যে বিরহবোধ জেগেছে তাকে বলে—ভবন বিরহ। আর ভূত বিরহ হল অতি বিরহ। কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেছেন। রাধার মনে অনন্ত বিচ্ছেদ বেদনা এই হল ভূত বেদনা। এই তিনটি বিরহকে এক সঙ্গে সুদূর প্রবাস বলা হয়। আর বৈষ্ণব পদাবলীতে এই সুদূর প্রবাস মাথুর নামে পরিচিত। 

মাথুরের আধ্যাত্মিকতা:

মাথুর কথাটির সঙ্গে মথুরা স্থানের সংযোগ আছে। বৃন্দাবন ছেড়ে কৃষ্ণ মথুরায় চলে গিয়েছেন চিরকালের জন্য। বৃন্দাবনে রাধার কাছে সেই বেদনা ছিল অন্তহীন। শুধুমাত্র রাধাই নয় সমগ্র বৃন্দাবন বাসীর মনে সেই কারণে অপরিসীম বেদনা অনুভূত হয়েছিল। এই পর্যায়ে আধ্যাত্মিক তাৎপর্য গভীর। কৃষ্ণ পরমাত্মা আর রাধা জীবাত্মার প্রতীক। মাথুর পর্যায়ে কৃষ্ণের থেকে চিরকালের বিরহ লাভ করে জীবাত্মা রাধা পরমাত্মার সঙ্গে  চিরমিলনের প্রস্তুতি। মাথুর বিরহের চরম পর্যায়। সমসাময়িক বিরহে আছে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা। কিন্তু মাথুরের পর অলৌকিক জগতে তার মিলন ছাড়া লৌকিক জীবনের মিলন সম্ভব নয়। আর ভাব মিলনাত্মক মনের যে মিলন তা চিরমিলন। এটাই ঘটেছে বৈষ্ণব পদাবলীর ভাবসম্মিলন পর্যায়ে। রবীন্দ্রনাথও একারণে বলেছেন—“মিলন ও বিরহের মধ্যে বিরহ-ই অধিকতর স্পৃহাহীন।” ভক্ত কবিরা বলেছেন—“বিরহ ভিন্ন দেহ যে শূন্য।”

মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও তাঁর কৃতিত্ব:

তাত্ত্বিক দিক ছাড়াও রস বিচারে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের ক্ষেত্রে মাথুরের পদগুলি যথেষ্ট। বৈষ্ণব কবিগণ তত্ত্ব ছাড়াও এই পদগুলির মধ্যে রাধার হৃদয়ার্তি বর্ণনা সূত্রে শাশ্বত প্রেমিকার অন্তহীন ব্যথার কথা বর্ণনা করেছেন। কৃষ্ণ হৃদয়ে রাধার বুক ভরা হাহাকার তাঁরা একান্ত হয়ে প্রকাশ করেছেন। তবে সকল বৈষ্ণব কবির মধ্যে মাথুর পদরচনায় বিদ্যাপতি শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তার মাথুরের বিরহের হৃদয়—“অনন্ত অশ্রুধারার নির্ঝর বলা যায়।” শ্রীকৃষ্ণ বিরহে গোকুলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা বিদ্যাপতি আমাদের অনুভব গ্রাহ্য করে তুলেছেন। রাধার জীবন-মন-দেহ-প্রাণ ছিল কৃষ্ণ সমর্পিত কিংবা বলা যায় কৃষ্ণই রাধার জীবন, কৃষ্ণ ছাড়া সে অস্তিত্ব হীন। কৃষ্ণের কারণে রাধা ছেড়েছিলেন জাতি-কুল-মান। অথচ সেই কৃষ্ণই তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এই অবস্থায় রাধার অন্তরে যে হৃদয়ার্তি তা যেন বিদ্যাপতির হৃদয়াভ্যন্তরে বেদনার সুর অঙ্কিত করেছেন। আর তার লেখনীতে প্রকাশ করে।

আর বিদ্যাপতি যে পদটি আমাদের আলোচ্য তাতে শ্রাবণের বর্ষণ ধারায় রাধার বন্যায় ধ্বনি আমরা শুনতে পায়, পদটি আলোচনা করলে দেখা যায় কংসকে বধের জন্য কৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পর বর্ষার প্রেক্ষাপটে প্রকৃতির আনন্দের প্রাচুর্যের কৃষ্ণের জন্য রাধা পাগলিনী হয়ে উঠেছে। আকাশ ঘিরে সজল মেঘমালার গম্ভীর গমনাগমন আর উপরে গভীর নিশিতে নিকষ অন্ধকারের প্রলেপ অবিরাম বাদলের ধারা ঝরেই চলেছে। এমন ঘনঘোর বর্ষায় রাধার মনপ্রাণ প্রিয় সঙ্গমের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু কৃষ্ণ যে আজ বৃন্দাবনে নেই। তাই রাধা বুকফাটা আর্তনাদ নিয়ে সখীদের বলেছে—

    “এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

এ ভরা বাদর                        মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর।।” 

বর্ষার রাত্রিতে শ্রীরাধার অন্তর্বেদনা অপরূপ বর্ণিত হয়েছে। ভাদ্রমাসের অসীম আকাশ জুড়ে মেঘমালা বিস্তার দিগন্ত জুড়ে অবিরাম বাদলের ধারা জুড়ছে। ঘন ঘন বজ্রপাত আর মেঘগর্জন।

“ঝঞঝা ঘন                        গরজন্তি সন্ততি

ভুবন ভরি বরিখিন্তিয়া।।”

এই পটভূমিকায় ধীরে ধীরে রাধা প্রেমিকের কামনায় অধির হয়েছে।

বর্ষার আগমনে বুকে নেমে এসেছে আনন্দের উচ্ছলতা। দূরে জলাভূমি থেকে ডাহুক-ডাহুকীর ডাক নেমে আসে। জলাশয়ে দাদুরী যত নেমে আসে বনান্তরালে ময়ূরের উন্মুক্ত নৃত্য শুরু হয়ে যায়। সবকিছু যেন রাধার বিরহের ব্যাকুল চিত্তে বজ্র শেল নিক্ষেপ করে। চারি দিকে মিলনের সমারহ। চারি দিকে প্রেমের গুঞ্জন। কিন্তু রাধার প্রিয় আজ কতদূরে। রাধার সেই হৃদয় যন্ত্রণার কথা ব্যক্ত করে—

“কুশিল শত শত            পাত-মোদিত

             মূর নাচত মাতিয়া।

মত্ত দাদুরী                 ডাকে ডাহুকী

         ফাটি যাওত ছাতিয়া।”

প্রেমের তীব্র জ্বালায় রাধাকে ঘর সরের বিদ্ধ করেছে। বিদ্যাপতি আসলে রাধার হৃদয়ের ব্যথা বোঝানোর জন্য প্রকৃতির আনন্দে উৎফুল্ল বিপরীত চিত্রটি শব্দের ধ্বনি রসময়তায় ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার অন্যদিকে দেখলে চারিদিকে যে ঘন অন্ধকারের বর্ণনা তা যেন রাধার অন্তরের বহিঃপ্রকাশ। তার হৃদয়ের যে অস্থিরতা তা যেন অস্থির বিদ্যুতের ঝিলিকে প্রকাশিত। বর্ষার প্রকৃতি প্রেক্ষাপটে নিজ নিজ প্রিয় সঙ্গলাভ করেছে। কিন্তু অভাগিনী রাধা ব্যতিক্রম। তার সমব্যথী হয়ে তার জন্য দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে কভি বলেছেন—

“কৈছে গোঙায়বি / হরি বিনে দিন রাতিয়া।”


বিদ্যাপতির মাথুর পর্যায়ে যে বেদনার ভাব জাগিয়েছেন তা অনির্বচনীয়। কেবল মাত্র এই একটি পদ নয়, বিদ্যাপতি তাঁর অন্যান্য মাথুরের পদ যেমন—“চির চন্দন উরে হার না দেলা”, “অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব” প্রভৃতি পদে মাথুরের স্বর্গীয় স্মৃতি শুনিয়েছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাষা তাকে ভাব প্রকাশে সাহায্য করেছে। ফলে পদগুলি হয়ে উঠেছে কালজয়ী। করুণ রস সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি সর্বচ্চসীমা স্পর্শ করতে পেরেছেন। কৃষ্ণ বিরহে রাধার অঝর ক্রন্দনে চিরন্তন প্রেমিকার বুকভরা আর্তির প্রতিধ্বনি সংবেদনশীল কবি শুনিয়েছেন। এবং সকল পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন। বিদ্যাপতির আলোচ্য সমস্ত পদগুলির মধ্যে যে অসাধারণ কাব্য সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়েছে তাঁর মূল রহস্য এখানে।