‘ছেঁড়াতার’ নাটকে মহিম চরিত্র:
‘ছেঁড়া তার' নাটকে মহিমের পরিচয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাধারণ প্রতিনিধিত্বেই শেষ হয়ে যায়নি। নাটকীয় তাৎপর্যেও উপস্থাপিত। মহিম চরিত্রটি রহিমের বন্ধু হয়ে প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে যে ঘটনার উৎপাদক, প্রথম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্য পর্যন্ত সে ঘটনা সম্প্রসারিত। মহিমের উৎসাহে কেনা শাড়ি জুতো দিলরুবা ইত্যাদির দ্বারা তৃতীয় দৃশ্যে রহিম-ফুলজানের প্রেম যেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে, আবার রহিমের জীবনে সংকটও উপস্থাপিত। মহিম-রহিমের বন্ধুত্বের নাট্য প্রয়োজন তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে রহিমের তালাক দানের পরবর্তী সময়ে। নাট্য ঘটনাকে চারমাসে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য মহিমের আশ্রয়ে রহিমকে থাকতে হয়। মনে রাখতে হবে, এই চারমাস অতিবাহনের কারণে রহিম ফুলজানকে ফিরিয়ে নিতে গিয়ে নিকার পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। এবং নিকার কারণে নাটকের শেষ পর্বে সংকট তীব্র হয়— যার পরিণতি রহিমের আত্মহত্যা। শুধু তাই নয় মহিমের সংস্পর্শেই রহিমের হঠকারী মানসিকতা, প্রতিভা, শিল্পিত রুচি, বুদ্ধির পরিচয় ও জীবনেতিহাস প্রকাশ পায়।।
মহিমের বোধ সুশান্তর মতো উপর-উপর নয়। জীবনকে দেখার চেষ্টা জানার প্রয়াস তার মধ্যে আছে। তবু মহিমের একটি সংলাপ আমাদের পরিপন্থী ভাবনায় পৌঁছে দিতে পারে–
মহিম। শোন্ রহিম। যাঁরা ধর্মের বিধান দেন, যাঁদের বিধান মেনে জগতের কোটি কোটি লোক শান্তি পায়, তাঁরা মহামানব এবং অসাধারণ বলেই ত’ তাদের দেবতা বলে লোক শ্রদ্ধা করে। কিন্তু। ১৫ শ' বছর বাদে মানুষের এমনই দুর্দিন আসবে তা হয়ত তাঁরা ভাবতেও পারেন নি। ভাবতে পারলে তারও বিধান তাঁরা দিতেন – নিশ্চয় দিতেন।
মহিমের মধ্যে ভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ থাকলেও অজ্ঞতা আছে। অন্যদিকে সুশান্তর মধ্যে সেই শ্ৰদ্ধাবোধটুকুও নেই। যে হদীজ একজন মুসলমানের কাছে শ্রদ্ধার চূড়ান্ত শিখরে রয়েছে, সেই হদীজ সম্পর্কে একজন মুসলমানের সামনেই বিকৃত মনোভাবের পরিচয় দেওয়া ভয়ানক অসম্মানের। সুশান্তর সংলাপ তার দৃষ্টান্ত—
সুশান্ত। ...এখানে আর হদীজ ফদীজ নিয়ে কে মাথা ঘামাচ্ছে ?
মহিমের মধ্যে এজাতীয় উচ্চমন্যবোধ আশাই করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হল, মহিম যদি অজ্ঞ হয় – তার শিক্ষা দিয়ে ব্যাপারটিকে জানার চেষ্টা কেন করেনি। করলে হয়ত রহিমকে আত্মহত্যা করতে হত না। মহিমের এই নিঃস্পৃহতা দুটি কারণে।
প্রথমত, সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মানুষদের সংখ্যালঘু সমাজজীবনচর্চা সম্পর্কে অনীহা।
দ্বিতীয়ত, মইনুল হাসানের ‘ইসলামী আইন এবং বর্তমান সময়’ প্রবন্ধের ভাষায় বলা যায়–
যেহেতু মুসলিমরা এ দেশে সংখ্যালঘু সেহেতু তাঁরা পৃথিবীর অন্যান্য অংশের সংখ্যালঘুদের মতোই সমস্যার মধ্যে আছেন।
সেই সমস্যার অন্যতম একটি তাঁর মতে ‘নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকা'। এখানে রহিমের সমস্যাও কিন্তু একই রকম—
রহিম। (ক্ষুণ্ণ হয়ে) ওসব কথা থাকুক।
মহিম তার পরম বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও বিষয়টি এড়িয়ে গেছে রহিম। অবশ্য মহিমের আলোচ্য সংলাপটিতে মহিমের আন্তরিকতা, সহানুভূতি ও পরমধর্ম সম্পর্কে এই শ্রদ্ধাবোধটুকু প্রত্যাশিত, কিন্তু তার কাছে সক্রিয়তা দাবি করলে নাট্যগতি ভিন্নপথে যেত, বদলে যেত কাহিনির পরিণতি, পরিকাঠামো পর্যন্ত। যা এখন আর প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। রহিমের সংকটে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা নিয়েও মহিম মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে– বন্ধু বলে নয়, মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। তাই ফুলজানকে রহিমের ফিরিয়ে নেবার ব্যাপারটি মানবতার যুক্তিতে ভেবেছে মহিম—
মহিম। সেই দুই মাসের জায়গায় আজ চার মাস হয়ে গেল। নিত্য দিন গুনে গুনে হতাশ হয়ে তোর বিবি যদি বাঁদীই হয়ে থাকে, সে কি তার অপরাধ? ছেলেটা যদি হতাশায় অসুস্থ হয়েই থাকে, সে কি তার অপরাধ? মরণের পর যে দিন জবাব দিতে দাঁড়াবি, সে দিন এক নির্দোষ মায়ের লাঞ্ছনা – অবোধ নিরপরাধ ছেলের যন্ত্রণা, যা তুই নির্বোধের মত খামখেয়ালী করেই দিয়েছিস, তার জবাব দিবি? রহিম তুই ত’ অবুঝ নোস্! মার বুক থেকে ছেলে ছিনিয়ে এনে তাকে মেরে ফেলিস্ নারে। তাকে বাঁচা-বাঁচা
লক্ষণীয়, এর পরেই কিন্তু রহিম গ্রামে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, নাটকের গতি অনেকটাই নির্ভর করে আছে মহিম চরিত্রটির উপর। মহিম চরিত্রটি অনিবার্য না হলেও অপরিহার্য—নাট্যগতিতে তাৎপর্যমণ্ডিত।