‘কবিকঙ্কনচণ্ডী’ কাব্যের ভাঁড়ু দত্ত চরিত্র
ভাঁড়ু দত্ত:
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে চণ্ডীমঙ্গলরে রচয়িতা মুকুন্দরামের কৃতিত্ব গগনস্পর্শী। তিনি তার কাব্যে কেবল প্রধান চরিত্র নয় অপ্রধান চরিত্রগুলির প্রতিও সমান যত্ন ও সহানুভূতি আরোপ করেছেন। খল চরিত্রগুলি কবির হাতে কালোত্তীর্ণ মাত্রা পেয়েছে। ভাঁড়ু দত্ত চরিত্রটির মধ্য দিয়ে কবি এক প্রচ্ছন্ন পরিহাস-কৌতুকের আমদানি করেছেন। এই খল প্রকৃতির দুষ্ট ব্যক্তির নীচতা ও স্বার্থপরতার জন্য কালকেতুকে অশেষ নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে, তবুও কবি এসব ভুলে গিয়ে চরিত্রটি কৌতুক পাত্রে পরিবেশন করেছেন। মুকুন্দরাম এই চরিত্রের মধ্যে দেখেছেন কাম্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা না পাওয়ার একটি বিপর্যস্ত চিত্ত কেন্দ্র। ভাঁড়ু নিজের বংশ কৌলীন্য এবং বুদ্ধি ও প্রতিভা সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করত। কিন্তু তার ক্ষমতার পরিণাম কতদূর তা কবির দেওয়া বর্ণনাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে
“উঠানে ডুবিয়া মরি না জানি সাঁতার।
জটে ধরি পত্নী মোরে করিল নিস্তার।"
আসলে তার দম্ভ মাত্র সম্বল। শুধু কাপট্যের মূল্যে, শাঠ্যের কৌশলে সে সামাজিক শ্রেষ্ঠত্ব পেতে চায়। কালকেতুর নবনির্মিত গুজরাট নগরে আরো বহু লোকের সঙ্গে ভাঁড়ু দত্তের আগমন ঘটেছে। তার আগমনটি যেন আবির্ভাব –
“ভেট লইয়্যা কাঁচকলা পশ্চাতে ভাঁড়ুর শালা
আগে ভাঁড়ু দত্তের পয়ান।
ভালে ফোঁটা মহাদম্ভ ছেড়া ধুতি কোঁচা লম্ব
শ্রবণে কলম খরশান।।”
ভাঁড়ু দত্ত বাঙালী মোড়ল জাতের প্রতিনিধি। তার সাজসজ্জা, কথাবার্তা লোক ঠকানো ভাব, আস্ফালন ও মিথ্যাচার এক বিশেষ শ্রেণীর বাঙালীকে চিনিয়ে দেয়। সে যেন শরৎচন্দ্রের বেণী ঘোষালের পূর্ব পুরুষ। একে একে সবাইকে বাকচাতুরীতে মুগ্ধ করে সে টাকাকড়ি আদায় করতে থাকে। তা দেখে কালকেতুর আর সহ্য হোল না- সে অর্থাৎ কালকেতু ভর্ৎসনা করে বলল—
“ভাঁড়ু কি তোর ব্যবহার।
কি কারণে লোট হাট রাজার বাজার।।”
কিন্তু ভাঁড়কে পণ্যদ্রব্য লুঠ করতেই হয়। কারণ তার বাঁচার অন্য কোন পথ নেই। শুধু দারিদ্র্য দূরীকরণ নয়, সে সামাজিক মর্যাদাও পেতে চায়। তাই সামাজিক মানী ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার জাত ক্রোধ দেখা দেয়। বুলান মণ্ডল প্রমুখের সম্মান দিলে সে ক্ষোভ ঢেকে রাখতে পারে । বলে –
“দিয়ান ভেটের বেটা বহিত আমার চিঠা
যারে বল বুলান মণ্ডল।”
কালকেতুর মতো নায়ক চরিত্রকেও বশে আনতে চায়। তার কূটবুদ্ধির প্রশংসাই করতে হয়। কালকেতুর কাছে আশ্রয় পেতে ভাঁড়ু আপন বংশ মর্যাদা তুলে ধরে। সে আমলহাড়ার দত্ত পরিবারের সন্তান। তার দুটি বিয়ে, মেয়েরও বিয়ে দিয়েছে, অবশ্য তা মিত্রবংশে। অর্থাৎ সে কায়স্থ কুলীন সম্পর্কান্বিত। তার পরিবারও যে নিতান্ত ছোট নয় তা জানিয়ে দিতে ভুল করে না সে
“বহু পরিবার মালা দুই মাগু চারি শালা
চারিপুত্র বহিনি শাশুড়ি।
ছয় মাতা আট ঢেড়ী এই হেতু ছয় বাড়ি
ধান্য দিলে নাহী দিব বাড়ি।।”
ভাঁড়ুর হাট বাজারে অন্যায় কর্মের চিত্র বাস্তব শিল্পী মুকুন্দরামের লেখনীতে অপূর্বমণ্ডিত -
“পসার লুটিআ ভাঁড়ু ভরয়ে চুপড়ি।
যত দ্রব্য লয় ভাঁড়ু নাহি দেয় কড়ি।।
লণ্ডে ভণ্ডে দেয় গালি বলে শালা মালা।
আমি মহা মণ্ডল আমার আগে তোলা।।”
এ কাজ অসামাজিক হলেও চরিত্রটি কিন্তু জীবন্ত। সে অকৃতজ্ঞও বটে। যে কালকেতু তাকে আশ্রয় দিয়েছিল তার নগরে, সেকালকেতু অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে সে অমার্জিত ভাষায় বলেছে---
‘তিন গোটা তির ছিল একখানি বাঁশ।
হাটে হাটে ফুল্লরা পসরা দিত মাস।।
দৈব দোষে আমি যদি আছিলা কাঙাল।
দেখিয়াছি খুড়া হে তোমার ঠাকুরাল।।”
এ কথায় কালকেতু রেগে গেলে তাকে নগর থেকে নির্বাসিত করে। ফলে ভাঁড়ুর চক্রান্তে কালকেতু বন্ধ হয়। কিন্তু দেবীর কৃপায় কালকেতু পুনরায় রাজ্য ফিরে পেলে ভাঁড়ু এসে তাকে বলে—
“তুমি খুড়া হৈলে বন্দী অনুক্ষণ আমি কান্দি
বহু তোমার নাহি খায় ভাত।।”
কিন্তু কালকেতু ভাঁড়ুকে চিনতে পেরেছে। তার শাস্তি দিল সে। তার মুখে অভক্ষ্য পুরে, বোঁচা ক্ষুরে দাড়ি মুড়িয়ে তাকে নির্যাতন করলো। আবার কেউ কেউ তার মাথায় ঘোল ঢেলে গলায় জবাফুলের মালা দিয়ে বলির পাঁঠা সাজিয়ে দিল।
মুকুন্দরাম এই চরিত্রটিকে তার কাব্যের মধ্যে এনে যে হাস্যরস পরিবেশন করেছেন তা আমাদের রস পরিবেশন করে। মুকুন্দরাম চরিত্রটি পাপের শাস্তি ও ক্ষমার দ্বারা Poetic Justice-এর প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। তাই আমাদের যেমন হাসায় তেমনি আমাদের হৃদয় সহানুভূতিও আকর্ষণ করে। কাব্যে যে হাস্যরস পরিবেশিত হয়েছে তা যে কেবল ভাঁড়ুকে অবলম্বন করে তাতে কোন সন্দেহ নেই।