-->

বাংলা সাহিত্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান ও কৃতিত্ব

 সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩):

বাংলা সাহিত্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান ও কৃতিত্ব

সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩):

সাম্যবাদী চিন্তা ও আদর্শের প্রতি গভীর প্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কাব্যজীবন শুরু করেন। প্রায় কৈশোর থেকেই তিনি ভারতীয় কম্যুনিষ্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী। ছাত্র আন্দোলনে তাঁর ভূমিকাও ছিল সক্রিয়। ১৯৪২-এ তিনি পার্টির সদস্য হন এবং তারপর থেকে সার্বক্ষণিক কর্মী। দর্শনে স্নাতক হন তিনি। পার্টির আদর্শ প্রচারে তিনি ছিলেন নিরলস। তাই তাঁর কবিতায় দলীয় ইস্তাহারের ভাষা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখতে পারেননি দলীয় কর্মধারার উপর। জীবনের মধ্যপর্বেই পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। দলের আদর্শের প্রতি যথেষ্ট বিশ্বাস এবং আনুগত্য থাকলেও ব্যক্তি চিন্তার স্বাধীনতাকে কখনই তিনি উপেক্ষা করেননি। তাই কবি সুভাষের দেশ এবং জাতির প্রতি চিরদিন দায়বদ্ধতা।

১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী মনের সঙ্গেও তাঁর নিবিড় যোগ ছিল। এই রাজনৈতিক সক্রিয়তার ফলে তাঁকে একাধিকবার জেলও খাটতে হয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিকপ্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। পদাতিকপ্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেনসুভাষ বোধহয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা নিয়ে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না। এমন কি প্রকৃতি-বিষয়ক কোনো কবিতাও লিখলেন না। এটা বোঝা যাচ্ছে যে এখন আমরা ইতিহাসের এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, যখন বাঙালি কবির হাতেও কবিতা আর শুধু বীণা হয়ে বাজছে না, অস্ত্র হয়েও ঝলসাচ্ছে।বুদ্ধদেব বসু পদাতিকের রচনাশৈলীরও প্রসংশা করছেন অকুণ্ঠভাবে।

পদাতিকের সেদিনের কবিতায়কবি এক নতুন সম্ভাবনার কথা লিখলেন

প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য

ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা

চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য

কাঠ ফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।

জীবনের এক নতুন প্রত্যয় ধ্বনিত হল নতুন যুগের কবির লেখনীতে। তাঁর বধূকবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

বর্তমানের কবি লিখলেন

গলির মোড়ে বেলা যে পড়ে এলো

পুরনো সুর ফেরিওয়ালার ডাকে

দূরে বেতার বিহার কোন মায়া

গ্যাসের আলো জ্বালা এ দিনশেষে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় পরবর্তী দুটি কাব্য চিরকুট (১৯৪৬) এবং অগ্নিকোণ (১৯৪৮)। চিরকুটের কবিতাগুলি লেখা হয়েছিল ১৯৪১ থেকে ৪৬-এর মধ্যে। কবিতাগুলিতে সমকালীন রাজনৈতিক উত্তাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। ইতিমধ্যে বিশ্ব তথা ভারতের মানচিত্রের বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৩৯-এ বিশ্বযুদ্ধের শুরু। এর মধ্যে ১৯৪২ এ ভারত ছাড়ো আন্দোলন। এই সময় সুভাষের কণ্ঠে জনযুদ্ধের গান

বজ্রকণ্ঠে তোলো আওয়াজ

রুখবো দস্যুদলকে আজ

দেবে না জাপানী উড়োজাহাজ

ভারতে ছুঁড় স্বরাজ।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে অশান্তি ঘূর্ণি হওয়া বইতেই থাকে। এর মধ্যে প্রধান হল ১৯৪৬ এর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪৭-এ খণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতা। প্রেরণা পরিকল্পনা, ব্যক্তিগত উদ্দীপনা একাকার হয়ে প্রকাশ পায় সুভাষের কবিতায়।

প্রায় চার বছর কবিতা লেখেননি সুভাষ (১৯৪৮-৫১)। তারপর প্রকাশিত হল তাঁর চতুর্থ কাব্য ফুল ফুটুক’ (১৯৫৮)। এই কাব্যগ্রন্থে আমরা পেলাম কবির সেই অনবদ্য কবিতা- যা আজও বাঙালি হৃদয়কে আকুল করে

ফুল ফুটুক না ফুটুক

আজ বসন্ত।

শান বাঁধানো ফুটপাতে

পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাহ

কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসছে।

এ গলির এক কালো-কুচ্ছিত মেয়েরগায়ে উড়ে এসে বসে প্রজাপতি- পোড়ার মুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতিযতদূরে যাইকাব্যখানি প্রকাশিত হয় ১৯৬২ তে। কবির অনুভূতি দিনে দিনেই প্রখর হয়েছে। কবির ভাষায়

আমি যত দূরে যাই

আমার সঙ্গে যায়

ঢেউ-এর মালাগাঁথা

এক নদীর নাম

আমি যত দূরে যাই।

পরবর্তী কাব্যগুলিতে কবি হৃদয় আজও সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। সহজ সরল বাঙালি জীবনের ছবি যেন স্পষ্টতর হয়েছে পরবর্তী কাব্যগুলিতে। কবির পরবর্তী কাব্যগুলি হল-কাল মধুমাস’ (১৯৬৬), ‘এই ভাই’ (১৯৭১), ‘ছেলে গেছে বলে’ (১৯৭২), ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’ (১৯৭৯), ‘জল সইতে’ (১৯৮১), ‘চই চই-চই চই’ (১৯৮৩), বাঘ ডেকেছিল (১৯৮৫), ‘যাবে কাগজের নৌকা

আনুষ্ঠানিকভাবে দলের সঙ্গে যোগ থাকলেও মার্কসীয় মানবতা বোধের গভীর অনুভবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য জগত মরমী।