সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাসের বিলুর চরিত্র
‘জাগরী’ উপন্যাসের বিলুর চরিত্র
সতীনাথ ভাদুড়ির “জাগরী” উপন্যাস আরম্ভ হয়েছে বিলু নমের একটি চরিত্রের স্মৃতি ও
আত্মকথনের মধ্য দিয়ে। বস্তুতঃ বিলু পর্বই এই উপন্যাসের প্রথম পর্ব। ফাঁসি হবার
ঠিক আগের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বিলুর এই স্মৃতি এবং
আত্মকথন এই উপন্যাসের সম্পদ বিশেষ। যে সময়ে জাগরী লেখা হয়েছে,
সেই উত্তাল রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যে অসংখ্য বাঙালী
মধ্যবিত্ত যুবক জীবনকে আহুতি দিয়েছে দেশমাতৃকার চরণে। আমাদের বিলু এই গোত্রেরই
একজন। কয়েকটি স্মৃতি, কতকগুলি ভাবনার মধ্য দিয়ে বিলু চরিত্রের চরিত্রধর্ম বিকশিত।
বিলুর ছোটোবেলার কথা আমরা বিলুর আত্মকথনে জানতে পারি না,
প্রথম জানতে পারি তার মায়ের একান্ত আত্মকথনে “বিলু যখন হয় তখন দিব্যি মোটাসোটা ছিল এতবড় কোলজোড়া ছেলে
। আঁতুড়ে হেড পণ্ডিতজী স্ত্রী দেখতে এসেছেন। রুক্মিনীদাই একধাবড়া কাজল ছেলের
গায়ে লাগিয়েছিল...।” অর্থাৎ বিলুর জন্মটা একান্ত মধ্যবিত্ত বাঙালী জীবনচর্যার,
সংস্কার ঘেরা সংস্কৃতির মধ্যে। বাবা ছিলেন বিদ্যালয়ের
চাকরীজীবি। মা ছিল একান্ত বাঙালী গৃহবধূ। এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে বড়ো হয়েছে বিলু।
গান্ধীবাদী বাবা আর নিবেদিতপ্রাণ মায়ের পাশে বিলু বড়ো হয়েছে। তার মাথায়
কোঁকড়া চুল, ফুটফুটে
রং,
একটু মেয়েলি মেয়েলি লম্বা ধরনের মুখ,
চিবুকটি সরু, কালো চোখের গভীর দৃষ্টি ভাবুকতায় ভরা। বিলুর স্বভাবের
মধ্যে কোমল দিক যে একটি ছিল তা বোঝা যায় মায়ের কথায় “যখনই মেয়ের কথা মনে হয়, তখনই মনে হয় বিলু আমার মেয়ে... । বিলুর স্বভাব মেয়েদের
মতোই নরম;
ওর ব্যবহার সেই রকমই দরদভরা, মেয়ের মতো ওর সহ্য করবার ক্ষমতা,
আর সেই রকমই ওর চোখে একটুতে জল আসে।”
বিলুর মধ্যে একটা পুরুষসিংহ বাস করতো। বাবা তার আত্মকথনে
বলেছিল—“যে বিলু আমার মুখের দিকে তাকাইতে পারে না,
তাহার চোখে সেদিন দেখেছিলাম সুপ্ত পৌরুষের ব্যঞ্জনা।”
তার চোখদুটি দিয়ে আগুনের ফুলকি যেন ঝড়ে পড়ে। হয়তো
বিলুকে ঠকিয়ে, খোশামোদ
করে কিংবা কোমল হৃদয়ের সুযোগ নিয়ে অনেকে অনেক কাজ হয়তো করাতে পারে,
কিন্তু গায়ের জোরের প্রসঙ্গ উঠলেই বিলুকে আটকানো বড় দায়।
তখন তার মধ্যে স্বাভাবিক নমনীয়তা যেন কর্পূরের মতো উবে যায়। মনে হয় এই সুপ্ত
পৌরুষত্বের বিস্ফোরণ থেকেই ধীরে ধীরে বিলু পথটা বদলে যায়। ছোটোবেলায় গান্ধী
আশ্রমে এবং গান্ধী সংস্কারে মানুষ হলেও শেষপর্যন্ত বিলু যোগ দেয় সোস্যালিস্ট
পার্টিতে।
বিলুর রাজনীতিবোধ কখনোই দেশের স্বাধীনতার থেকে বড়ো হয়ে
ওঠেনি। দেশপ্রেম যেন তার কাছে একটা আদর্শ, প্রার্থনা, সাধনা, তাই দেখি একজন জেল ওয়ার্ডার যখন দেশসেবক বিলুকে “আসামী” অভিধায় ভূষিত করে তখন বিলুর অন্তর ক্ষোভে,
দুঃখে ভরে ওঠে। মন বলে “একজন ওয়ার্ডারের চোখেও আমি পূজ্য দেশসেবক নই। আমি তাহার
নিকট হইতে আশা রাখি প্রশংসার। কথায় না হউক, অন্ততঃ হাবভাবে, আমার ত্যাগের জন্য। ইহাদের জন্য আমি প্রাণ বিসর্জন দিতেছি,
কোথায় ইহারা কৃতজ্ঞ থাকিবে তা নয়,
কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে ইহারা দিতে জানে সহানুভূতি,
... বিলু দেশের মানুষের সাম্যব্যবস্থা
চায়। প্রতি মানুষ যাতে সমান অধিকার পায়, বিলুর চিন্তা-চেতনা তার জন্যে। জেলে বসে বিলু তাই কংগ্রেস
বড়কর্তাদের প্রতি নির্দ্বিধায় প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে “কেন তাহারা সকল রাজবন্দীদিকের একটি মাত্র শ্রেণি করেন নাই ?
উচ্চশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণির রাজবন্দী রাখিবার অর্থ কি?...বাহির হইতে তাহাদের জন্য খাবার বা অন্য কোনো জিনিস আসিলে,
তাহা লইতেছিল, বড়কর্তাদিগের কোন পাকাধানে মই পড়িতো ?...”
একজন যথার্থ রাজনৈতিক কর্মীর অবস্থা সম্পর্কে বিলুর স্পষ্ট
মত এইরকম “পথ
বড় কঠিন,
বড় বন্ধুর।... আশা রাখিবে ফাঁসির রজ্জুর,
হয়তো গৌরবের রাজমুকুট পাইতেও পারো। অপার ক্লেশের জীবন।”
বিলুর চেতনায় এসেছে মার্কসবাদী পার্টির গঠন,
তাদের কর্তব্য, আদর্শ তথা নিয়মের কথা। আসলে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত বিলু এই
সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে। জেলের পণ্ডিতের চোখে সে নাস্তিক। বাবার পাঠানো গীতা সে
ফেরত পাঠিয়েছে। ধর্মোপদেশে তার কোনো প্রয়োজন নেই। অন্য ভালো বই হলে সে পড়তে
পারে। সরকারের সাথে কোনোরকম আপোষ মীমাংসায় যেতে সে রাজি নয়। আমরা দেখি ব্যক্তি
জীবনে সতীনাথও মার্কসবাদীদের এই নিয়মনীতিকে পছন্দ করতেন। তাই জেলে বিলুর চেতনায়
অবশেষে ধরা পড়েছে সেই দেশ গঠনের কথা, সেই সংগঠনের কথাই—‘আমার যদি অনেক টাকা থাকিতো, তাহা হইলে আজ উইল করিয়া যাইতাম।...তাহা দিয়া মার্কসবাদের
প্রচারকার্য চলিত। ভারতের প্রতি গ্রামে গ্রামে রুশের বালক ও কিশোরদের সংঘের ন্যায়
দলের সংগঠন হইতে পারিত ... ”
এ হেন রাজনীতি সচেতন বিলুর আত্মসম্মানবোধ অতি প্রবল। নিজে
যেমন দয়ার দান কারোর কাছ থেকে নেয় না, তেমনি তার ওপরেও কারও দয়াদাক্ষিণ্য সে অন্তরে মানতে পারে
না। আসলে কারোর কাছে মাথা নত করে বেঁচে থাকা তার স্বভাবের মধ্যে পড়েনি কোনোদিনই।
ফাঁসির আগের দিন কয়েদীকে তাঁর ইচ্ছেমত প্রায় সব জিনিসই দেওয়াহয়ে থাকে।
বেশিরভাগ লোকই ভালো খাবার-টাবার খেতে চায়। জেলের ঘরে মশার
প্রচণ্ড জ্বালায় বিলুর একবার ইচ্ছা হয়েছিল একটি মশারি চাওয়ার। কিন্তু ওই
আত্মসম্মানবোধ। বিলুর স্বগতকথনে—“আমার খুব লোভ হইয়াছিল। একটি মশারির কথা বলিতে—যে কয়েকদিন আরামে ঘুমাইয়া লওয়া যায়,
কিন্তু বলিবার সময় বলিতে পারিলাম না কেমন যেন আত্মসম্মানে
আঘাত লাগিতে লাগলো।"
বিলুর ফাঁসির শাস্তি হয় তারই ছোট ভাই নীলুর জবানবন্দিতে,
তাই বলে বিলু তার ভাইয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ নয়,
বরং গর্বিত। আসলে বিলু তার ভাইকে সামনে থেকে দেখেছে,
একাত্ম করে চিনেছে। তাই মরণের সীমায় দাঁড়িয়েও বিলু তাঁর
ভাইকে অস্বীকার করতে পারে নি। কারণ নীলুও স্বাধীনতা চায়,
তবে পথটা আলাদা। একটা দেশপ্রেমিকের কাছ থেকে এই আঘাতটা তার
আঘাত বলেই মনে হয় না। এ কাজ একমাত্র যেন বিলুর ভাইয়ের পক্ষেই সম্ভব। জবানবন্দী
দিতে গিয়ে নীলুর যে বাকরোধ হয়ে যায় নি, তা এই বিলুর ভাই বলেই। এই জায়গাতেই বিলুর গর্ববোধ
জীবনের শেষ অবস্থায় দাঁড়িয়ে বিলু সব ছেড়ে তারই একান্ত
প্রিয় জীবনটাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। জীবনের পুরানো স্মৃতিটাকে সজোরে আঁকড়ে ধরে
আরও একবার বাঁচতে চেয়েছে। সারারাতে জেলে যতবার ঘণ্টা বেজেছে,
ততবারই উত্তরোত্তর তার বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। বিলুর
বাঁচবার প্রবৃত্তি তার জীবনের সব স্বপ্নকে পিছে ফেলেছে। চেষ্টা করেও সে নীলুর
মুখটা ভুলতে পারে নি। নীলুর কথা মনে এলেই বিলুর অবচেতন মনের মানসিক সব দুশ্চিন্তা
একটা আকার নিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায় ‘নীলুর মুখটি মনে করিবার চেষ্টা করিতেছি। কিছুতেই মনে
আসিতেছে না। নীলুর মুখটি এখন মনে করিতে চাহিতেছি, শেষ মুহূর্তের একটু তৃপ্তির জন্য। কিন্তু এখন কি মনে
আসিবে...”
গরাদটা ধরে সে আস্তে আস্তে ওঠবার চেষ্টা করেছে। হাত পা তার
কাঁপছে,
মনে হচ্ছে পায়ের তলায় যেন পক্ষাঘাত হয়েছে। জিভটা শুকিয়ে
খরখরে হয়ে গেছে, আস্তে আস্তে গলার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। বেঁচে থাকবার আকুলতায় সে এখনও যুক্তি
খাড়া করেছে—“আমি
অতিমানব নই, আমি
সাধারণ রক্ত-মাংসের মানুষ, মানুষের দোষ, দুর্বলতা, ভ্রান্তি
আমার মধ্যে।” অথবা
সে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে “বাঁচিবার আকাঙ্ক্ষা আমায় কোথায় লইয়া যাইতেছে ?”
এই আশায় সে বারবার কল্পনার যুক্তি দিয়ে একটা সম্ভাবনা
গড়ে তুলেছে, আবার
নিজের হাতেই তা সে ভেঙে খানখান করে দিয়েছে। সে ভেবেছে “যে ফাঁসি দিবে তাহার যদি হঠাৎ অসুখ করে?...যদি হাইকোর্ট হইতে.... চিঠি আসিয়া থাকে,
আমার ফাঁসি বন্ধ করিয়া দিতে, আর দৈবাৎ ভ্রমসাথে তাহা যদি খোলা না হইয়া থাকে।”
জীবনে আসল বাঁচবার নোনা স্বাদটা বিলু বোধহয় এতদিনে অনুভব
করেছে। Warder-এর বুটের চলার শব্দ যত কাছে এসেছে,
বিলুর তত মনে পড়েছে তার মার কথা,
জ্যাঠাইমা, সরস্বতী, নীলু প্রত্যেকের কথা, পরিবারের সেই আনন্দঘন দিনগুলির কথা। যে জীবনটা তার খুব কাছে
ছিল,
যে জীবনটা সে সবার জন্য একদিন অকাতরে বিলিয়েছে,
আজ সেই জীবনটার কথাই সে ভাবছে এক চরম স্বার্থপরের মতো।
জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলিকে আবার সে কাছে পেতে চেয়েছে,
জীবনের দাবীতে জীবনের সব রঙকে আজ দু-হাত দিয়ে বিলু মাখতে
চেয়েছে নিজের হৃদয়ে, নিজের অন্তরে আত্মসচেতন অন্তর্মুখী বিলু আজ জীবনের দাবীতে শেষপর্যন্ত
জীবনপ্রেমিক হয়ে উঠল। বিলুর এই মানবিক সত্ত্বা তাকে আলোকিত করেছে,
পাঠকের একেবারে কাছে নিয়ে এসেছে।
“যখন
পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না, আমি বাইব না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে।”
বিলুর জীবন যেন এই জীবনের ঘাটে ঘাটে খেয়া তরী বাইতে না পারারই ইতিহাস। সতীনাথ
ভাদুড়ী যে বাঙালী জীবনটাকে আঁকতে চেয়েছিলেন এই উপন্যাসে সমকালীনকে আঁকড়ে ধরে;
বিলু সেই চেতনারই স্বার্থক চিত্ৰকল্প হয়ে উঠেছে।

