বাংলা নাটকে বাদল সরকারের অবদান: এক মূল্যায়ন
বাদল সরকার:
নাট্যজগতে বাদল সরকার নামে পরিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম
সুধীন্দ্র সরকার। নাটক বা ইত্যাদি ব্যাপারে পারিবারিক ধারাবাহিকতা না থাকলেও
বাল্যকাল থেকে নাটক এবং অভিনয়ের প্রতি তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। সেই পথে অগ্রসর হয়েই
তিনি নাট্যকার, অভিনেতা
ও পরিচালক হয়েছিলেন।
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বাদল সরকারের জন্ম হয় কলকাতায়। তাঁর পিতা
মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন স্কটিশচার্চ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। মাতার নাম সরলামোনা
সরকার।
কলকাতাতেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পরবর্তীকালে তিনি
শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তুলনামূলক
সাহিত্যে তিনি এম.এ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। রেডিওতে নাটক শোনার প্রতি তাঁর গভীর
আগ্রহ ছিল। এই সময় শিশির ভাদুড়ি, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অহীন্দ্র চৌধুরীর মতো দিকপাল অভিনেতারা রেডিওতে নিয়মিত নাটক
করতেন। এইসব নাটক শুনতে শুনতেই তাঁর মনে নাটক সম্পর্কে আগ্রহ জাগে। দামোদর ভ্যালি
কর্পোরেশনে চাকরি করার সময় একঘেয়েমি কাটাবার জন্য খোলেন রিহার্সাল ক্লাব। যদিও
বাধা অনেক এসেছিল তবু নাটক মঞ্চস্থ করলেন তিনি। নিখুঁত অভিনয় সার্থক পরিমণ্ডল
রচনার ফলে নাটকটি যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছিল।
এরপর কলকাতায় তিনি একটি বিদেশী নাটকের কাহিনী অবলম্বনে
প্রথম নাটক লিখেছিলেন ‘সলিউশন এক্স’। এই সময়েই তাঁর লন্ডন যাওয়ার সুযোগ ঘটে। সেখানে তিনি অনেক নাটক দেখেন। কার্লস
আরটন,
ভিভিয়াস লে, মাইক্সে বড়রেথ প্রভৃতিদের নাটকও দেখেন। নাটক লেখার উৎসাহ
সেখান থেকেই তিনি পেয়েছিলেন। এই উৎসাহেই তিনি প্রথম মৌলিক নাটক লেখেন ‘বড় পিসিমা’।
দেশে ফিরে কয়েকজন উৎসাহী বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘চক্র’ গোষ্ঠী। এই সময় তাঁর বিষ্ণু নাটক মঞ্চস্থ হয়। এগুলি হল- ‘বড় পিসিমা’, ‘শনিবার সমাবৃত্ত’, ‘রাম শ্যাম যদু’, ‘কবি কাহিনী’, ‘সলিউশন এক্স’ ইত্যাদি।
আবার তাঁর বিদেশ যাত্রা। এবার বৃত্তি নিয়ে গেলেন ফ্রান্সে।
তারপর সেখান থেকে নাইজিরিয়া। এই বিদেশ বাসকালে তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত নাটকগুলি- ‘প্রলাপ’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘যদি কোন দিন’, ‘বিংশ শতাব্দী’, ‘পরে আরেকবার’, ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘বিচিত্রানুষ্ঠান’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’, ‘কবি কাহিনী’, ‘সারা রাত্তির’। ১৯৬৫ সালে ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় তাঁর ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ নাটকটি প্রকাশিত হবার পর নাট্যজগতে বিপুল সাড়া পড়ে যায়।
গিরিশ কারনাড নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। ‘শৌভনিকে’র প্রযোজনায় নাটকটি মুক্তাঙ্গনে মঞ্চস্থ হয়। এই বছরেই তাঁর ‘কবিকাহিনী’, ‘রাম শ্যাম যদু’ নাটক দুটিও ‘রঙ্গসভা’র প্রযোজনায় নিউএম্পায়ারে এবং বর্তিকার প্রযোজনায় মঞ্চস্থ
হয়েছিল।
বাদল সরকার নিজেই নাট্যদল গড়লেন পরবর্তীকালে। নাম ‘শতাব্দী’। সেখানে তাঁর অভিনীত হয়নি এমন নাটকগুলিই অভিনীত হতে থাকে।
নাটক নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। প্রচলিত রীতি
নাট্য উপস্থাপনার মধ্যে নানা দুর্বলতাও দেখতে পেলেন তিনি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর ‘থার্ড’ বা মুক্তাঙ্গন থিয়েটারের চিন্তা দেখা দিল।
লন্ডনে, প্যারিসে নাটকগুলি হয় চারিদিকে ঘিরে থাকা দর্শকের মধ্যে।
তাছাড়া পোল্যান্ডের গ্রোটোস্কির নাট্যভাবনা তাঁকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করছিল।
এইভাবেই জন্ম হল ‘থার্ড’ থিয়েটারের।
বাদল সরকারের নাট্য জীবনের প্রথম পর্ব ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭
পর্যন্ত। এই পর্বের শেষ প্রসেনিয়াম থিয়েটারে ‘পাগলা ঘোড়া’ অভিনয়ের মধ্যে। নাট্যকারের নাট্য জীবনের দ্বিতীয় পর্ব থার্ড
থিয়েটারে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। প্রসেনিয়াম থিয়েটারে সাগিনা মাহাতো,
আবু হোসেন, বল্লভপুরের রূপকথা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে
(১৯৬৯) তিনি সংস্কৃতি আদান-প্রদানের প্রতিনিধি হয়ে রাশিয়া,
চেকোশ্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশে গিয়ে প্রচুর নাটক দেখেন। বিদেশের এই
নাটকগুলি দেখে ‘থার্ড’
থিয়েটার সম্পর্কে তিনি অনুপ্রেরণা লাভ করেন।
দর্শকদের মঞ্চে বসিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে ঘুরে ঘুরে সাগিনা
মাহাতো নাটকটি করার পর তিনি থিয়েট্রিকাল কমিউনিকেশনের গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন। বাদল
সরকার থার্ড থিয়েটারের দল গড়লেন-নাম ‘শতাব্দী’। মুক্তাঙ্গনে থিয়েটারের নানা সুবিধা। লাইট মেকআপের খরচ কম,
দর্শকদের টিকিট লাগে না, সরকারি অনুদান দরকার হয় না ইত্যাদি। অবশ্য তাঁর নতুন
কলারীতির বিরূপ পর্যালোচনাও যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজের প্রত্যয় থেকে সরে
আসেননি। তিনি লোকনাট্যকে প্রথম থিয়েটার, প্রসেনিয়াম নাটককে দ্বিতীয় থিয়েটার বলে চিহ্নিত করেছেন। আর
এই দুই থিয়েটারের নিশ্চিত প্রয়োগকলা তৃতীয় থিয়েটার। ১৯৭৮-এ তিনি তাঁর ‘দি থার্ড থিয়েটার’ বইটি লেখেন। নিজের রচিত ‘স্পার্টাকাস’ নাটকটি তিনি উপস্থাপিত করলেন থার্ড থিয়েটারে। এরপর ‘প্রস্তাব’, ‘লক্ষ্মীছাড়ার পাঁচালী’, ‘মণিকাঞ্চন’ মঞ্চস্থ হয় থার্ড থিয়েটারে। স্পার্টাকাস,
সাগিনা মাহাতোর পর তিনি রচনা করেন ‘ভোমা ও গতি’। তাছাড়াও ‘ভানুমতী কা খেল’, ‘হট্টমালার ওপারে’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। এছাড়াও আরও একাধিক নাটক অভিনীত হয়ে
জনপ্রিয়তা লাভ করেছে-এগুলি হল ‘সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস’, ‘মিছিল’, ‘ইঁদুর’-এগুলি সবই থার্ড থিয়েটারেই অভিনীত হয়।
বাদল সরকারের এই নূতন এবং অভিনব নাট্যপ্রয়াসকে সহজে সকলে
মেনে নিতে চাননি। তাই তাঁর দি থার্ড থিয়েটারকে অনেকেই পুওর থিয়েটার,
ফিজিক্যাল থিয়েটার, লিভিং থিয়েটার ইত্যাদি বলে নিন্দা করতে চেয়েছেন। কিন্তু
প্রচলিত চেনা পথে না চলে বাংলা থিয়েটারে তিনি যে একটি নতুন পথের দিশা দিয়েছিলেন
তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর এই নাট্য প্রচেষ্টার মূল্যায়ন কালই করবে। তবে বাংলা নাটকে
বিসর্পিল ইতিহাসে তাঁর নামটি যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই।