পোস্টমাস্টার - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রতনের সঙ্গে পোস্টমাস্টারের সম্পর্ক সৃষ্টিতে
রবীন্দ্রনাথের সার্থকতা / পোস্টমাস্টার গল্পে পোস্টমাস্টার ও রতন চরিত্র:
রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছোটগল্পের শুধু প্রথম স্রষ্টা নন, কিংবদন্তী পুরুষও বটে। ছোটগল্পের ছোট আধারে মানব জীবনের বিচিত্র রূপকে যে তিনি অঙ্কন করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বিভিন্ন সামাজিক অবস্থানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সূত্রের যে অক্ষর চিত্র রবীন্দ্র ছোটগল্পে অঙ্কিত হয়েছে, তার রহস্য উন্মোচন করতে গেলে আমাদের বিস্ময়াভিভূত হতে হয়। পোস্টমাস্টার গল্পটিতেও রবীন্দ্রনাথ সেই রকমের—এক অদ্ভুত ও অভিনব সম্পর্ক সূত্রের অবতারণা করেছেন। গল্পের চরিত্র সংখ্যা দুটি—পোস্টমাস্টার রতন। দু’জনেরই পশ্চাৎপট আড়ালে ঢাকা। শুধু এটুকু জানা যায় কলকাতার ছেলে পোস্টমাস্টার জীবিকার সূত্রে এসেছে উলাপুর গ্রামে। কলকাতায় তার মা ভাই ও দিদি রয়েছে। আর রতন পিতৃ-মাতৃহারা এক বালিকা। তার পূর্বস্মৃতি বলতে পিতার স্নেহ এবং গাছের ভাঙা ডালে নকল ছিপের কল্পনা করে নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে মাছধরা। কিন্তু পেছনের এই জীবন ইতিহাস পোস্টমাস্টার কিংবা রতন কারো ক্ষেত্রে কোন প্রত্যক্ষ সংবেদনা সৃষ্টি করে না। আবার উলাপুর গ্রাম থেকে পোস্টমাস্টারের চলে যাওয়ায় দুজনের জীবন কাহিনির কোন ইঙ্গিত ভাষায়িত হয়নি। মাত্র কয়েকটি মাস উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারের অবস্থানও সেই সূত্রে রতনের সঙ্গে তার পরিচয়ই গল্পের রহস্যজটিল সম্পর্ক সূত্রটি রচনা করেছে। সেদিক থেকে পোস্টমাস্টার অবশ্যই একটি নিখুঁত ছোটগল্প। কিন্তু গল্পের রসজগতে এই দুটি চরিত্রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মানব মনের অতলে অবগাহনের যে প্রয়াস চালিয়েছেন তার বিস্ময়করতা ভুলে থাকার নয়। পোস্টমাস্টারের সঙ্গে সম্পর্কের অভিনবত্বই সৃষ্টি করেছে এই বিস্ময় মুগ্ধতার পরিবেশ।
তপোব্রত ঘোষ তাঁর ‘রবীন্দ্র-ছোটগল্পের শিল্পরূপ’ গ্রন্থটিতে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের এই সম্পর্ক রহস্য বিষয়ে ইঙ্গিত করতে গিয়ে জানিয়েছেন—
“রবীন্দ্রনাথ নারী-পুরুষের মধ্যে অনেক সময় এমন একটি মিশ্র সম্পর্ক সৃষ্টি করেছেন যাকে বিশেষ কোন সংজ্ঞায় সুপরিস্ফুট করা যায় না। যেমন—‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে শশীভূষণ-গিরিবালা সম্পর্ক। পোস্টমাস্টার ও রতনের সম্পর্কও অনেকটা অনুরূপ।”
কথাটা হয়তো ঠিকই। কেননা সরাসরি পরিষ্কারভাবে এই সম্পর্ক সূত্রের গ্রন্থি ঘোষণা করা কখনোই সম্ভবপর নয়। তবু উল্লেখ্য এই যে, গল্পটি যা কিছু বিশেষত্ব তা রসগত আবেদন গড়ে উঠেছে এই সম্পর্ক সূত্রটিকে ভিত্তি করে। সুতরাং একে বাদ দিয়ে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের মূল্যায়ন কখনই সম্ভব নয়।
এই সম্পর্কের একটি গ্রন্থি হয়ত বা কিছুটা সহজগম্য। সেটি পোস্টমাস্টারের দিক। পোস্টমাস্টারের চরিত্রে লেখক তেমন কোন বিস্ময়কর রহস্য রাখেননি। তার মনের ছবি আমাদের কাছে জলের মতই সোজা। ড. ক্ষেত্র গুপ্ত লিখেছেন—
“পোস্টমাস্টারের চরিত্রে কোন বিস্ময়কর স্বভাবগত ভাট বা রহস্য নেই, তাকে রক্তমাংসের সহজ পরিচিত মানুষ হিসাবে আঁকা হয়েছে—কলমের দুচারটি দাগ দিয়ে অত্যন্ত অল্প আয়োজনে।”
—কথাটি ঠিক। চাকরি সূত্রে কলকাতা থেকে আসা যুবকের গ্রামে অবস্থিতির সমূহ মানসিক বৈশিষ্ট্য পোস্টমাস্টারের মধ্যে সুপরিস্ফুট। গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে দু-একটা কবিতা লেখাও কোন আশ্চর্যজনক ঘটনা নয়। জীবিকার তাগিদে গ্রামে এসে ভীত, কাতর, অসহায় ও একাকী হয়ে পড়া। ম্যালেরিয়ার ভয়ে বদলির প্রার্থনা এবং তা নামঞ্জুর হলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসা প্রবৃত্তি ঘটনাগুলির মধ্যে কোন অস্বাভাবিকত্ব নেই। রতনের সঙ্গে পরিচয় হওয়া এবং কিছুটা নিঃসঙ্গতাও কিছুটা স্নেহপরায়নতা তাকে আপন করে নেওয়ার বাসনাতেও কোন অতিরঞ্জনের রঙ লাগেনি। রতনকে আপন করে নেওয়ার মধ্যে যেমন কোন কুটিল মনস্তত্ত্ব নেই, তেমনি তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার মধ্যেও নেই কোন হৃদয়ের তন্ত্রীকাতরতা। রতনকে ক্ষণিকের জন্যও তার মনে হয়েছিল—
“এই সময়ে কাছে একটা কেহ নিতান্ত আপনার লোক থাকিত—হৃদয়ের সহিত একান্ত সংলগ্ন একটি স্নেহ পুত্তলি মানবমূর্তি।”
কিন্তু সেই স্নেহপুত্তলি মানব মূর্তি যে রতন, এমন কথা ভাবার কোন কারণ নেই। তাই চাকরি ছেড়ে দেওয়া কিংবা রতনকে ছেড়ে চলে যেতে তার কোন দ্বিধাগ্রস্ততা নেই। হৃদয়ের অন্তঃসার নেই কোন রক্তক্ষরণ। শুধু একবার, যখন সে সমস্ত কিছু ছেড়ে নৌকায় উঠে বসেছে, তখন চকিতের জন্য তার মনে হয়েছে—
“ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড় বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি।”
কিন্তু এ ভাবনা তার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা করুণা ছাড়া রতনকে ঘিরে তার মনে আর কোন প্রকার চেতনা গড়ে ওঠেনি। তাই অতি সহজেই সে সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে—
“জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কি: পৃথিবীতে কে কাহার।”
সুতরাং পোস্টমাস্টার এবং রতনের মধ্যে যে স্পর্শকগ্রন্থী, তাতে পোস্টমাস্টারের দিক থেকে কোন জটিলতা নেই। আঁচড়বিহীন কাগজের মতই তা সাদা। কিন্তু রতনের মানসিক গতি অনেকটাই বিসর্পিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন—
“নারী হৃদয় কে বুঝিবে?”
রতন পূর্ণ নারী হয়, বারো-তেরো বছরের বালিকা মাত্র। তবু তার হৃদয়ের রহস্যও বোঝা গেল না। রতন পোস্টমাস্টারকে কি চোখে দেখেছিল? প্রশ্নটির উত্তর সহজ নয়। তবুও রতনের মনের গভীরে অবতরণ করে সে চেষ্টা করা যেতে পারে।
পাশাপাশি সহাবস্থানের ফলে পোস্টমাস্টারের প্রতি রতনের মনে গড়ে উঠেছিল একটি সহমর্মিতার আবেশ। সহজাত বৃত্তি এটি। অল্প বয়স্ক হলেও পুরুষকে আপন কেন্দ্রাতিগ শক্তিতে আকর্ষণ করার অধিকার নিয়েই নারী পৃথিবীতে আসে। পোস্টমাস্টারের প্রতি রতনের আকর্ষণকে সেই শক্তিরই বিকাশ রূপে দেখা যেতে পারে। পোস্টমাস্টারের জন্য রান্না করার মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল, তা পরে ক্রমশ: ঘনীভূত হয়েছে। পোস্টমাস্টারের তাকে লেখাপড়া শেখানোর উদ্যোগ এ বিষয়ে বিশেষ সাহায্যকারী ভূমিকা নিয়েছে। পরে পোস্টমাস্টার জ্বরে আক্রান্ত হলে এ সম্পর্কের সূত্র আরও বেশি প্রসারিত হয়েছে—
“বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাক্রমে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য আনিয়া দিল।”
পুরুষ ও প্রকৃতি যে বিচিত্র লীলা পৃথিবীতে বহুরূপে প্রকাশিত হয়, এও তার একটি রূপ। সেবা-শুশ্রূষার মধ্যে দিয়ে রতনের মনে পোস্টমাস্টারের স্থান যখন পাকা, তখনই এল অভাবিত আঘাত। পোস্টমাস্টার চাকরি ছেড়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করল। বলল, সে আর কোনদিনই ফিরে আসবে না। একটু একটু করে সে ইমারত গড়ে উঠে ছিল তা সহসা এই অভাবিত আঘাতেই চুরমার হয়ে গেল। লেখক অপূর্ব প্রতীকে রতনের মনের এই ছবিটিকে তুলে ধরেছেন। রতন পোস্টমাস্টারের চলে যাওয়ার খবর শুনেও কিছু বলল না। কিন্তু—
“মিটমিট করিয়া প্রদীপজ্বলিতে লাগিল এবং একস্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি সরার উপর টপ টপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।”
এ শুধু প্রকৃতি জগতের বৃষ্টিপাতের শব্দ নয়, রতনের মনের জগতেও শুরু হয়েছে বারিবর্ষণ। অজস্র স্মৃতি তখন তার মনের উপর টপটপ করে ঝরতে শুরু করেছে। তারই ফলশ্রুতি রতনের এই প্রশ্ন—
“দাদাবাবু আমাকে তোমাদের বাড়ী নিয়ে যাবে?”
যে সামান্য আশাটুকু ছিল পোস্টমাস্টারের অস্বীকৃতিতে তাও নিঃশেষিত হয়ে গেল। তখন—
“সমস্ত রাত্রি স্বপ্ন এবং জাগরণে বালিকার কানে পোস্টমাস্টারের হাস্যধ্বনির কণ্ঠস্বর বাজিতে লাগিল—‘সে কী করে হবে।”
রতনের হৃদয়ের মূলধনে এখন টান পড়েছে। তাই অত্যন্ত ছায়ার্দ্রচিত্তে পোস্টমাস্টার যখন বলল যে, রতনকে সে তারই যত্ন করার জন্য পরবর্তী পোস্টমাস্টারকে বলে যাবে, তখন সইল না তার এ অপমান। এত তার প্রকৃতি সত্ত্বাকেই অপমান। তাই চোখের জলে সে জবাব দিয়েছে—
“না, না তোমাকে কাউকে কিছু বলতে হবে না, আমি থাকতে চাই নে।”
পোস্টমাস্টার যাওয়ার সময় কিছু টাকা দিয়ে যেতে চাইলেও সে স্পর্শ করেনি। হৃদয়ের সম্পর্ককে কি অর্থের মূল্য দিয়ে কেনা যায়? রতনের প্রকৃতি সত্ত্বার পূর্ণ জয় হল এখানে। কিন্তু এ জয় যে সীমাহীন শূন্যতার বিনিময়ে অর্জিত। সে মর্মকথা লুকানো স্থান তো তার নেই। তাই পোস্টমাস্টার চলে গেলেও—
“সে সেই পোস্টআপিস গৃহের চারিদিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।”
রতনের এই আকর্ষণ প্রেম নয়। যদিও প্রেম হলেই পাঠক বেশি স্বস্তি পেত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তত দূর অগ্রসর হতে নারাজ। তাই এক অদ্ভুত সম্পর্কের সূত্রে বেঁধে দিয়েছেন এই অপরিণত নারীর হৃদয়বৃত্তিকে। এই সম্পর্কের স্বরূপ স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু তাই বলে তাকে বিকৃত করে নেওয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। নাই বা গেল তাকে বাচনের স্পষ্টতায় ব্যাখ্যা করা, অনুভূতির জগতে সে তো হয়ে রইল বৈদূর্যমণি। তারই দীপ্ত প্রভাবে আলোময় হয়ে উঠেছে গল্পের রস জগৎ। ছোটগল্প রূপে ‘পোস্টমাস্টারে’র এই তুলনাহীন সফলতার স্মারক চিহ্নটি বাংলা সাহিত্যে অম্লান থাকবে চিরদিন।