-->

মহাভারতের অনুবাদকর্মে কাশীরামদাসের কৃতিত্ব

রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত অনুবাদের মাধ্যমে বাঙালীর চিন্তাভাবনা ও আবেগ উত্তরাপথের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির নিবিড় সংস্পর্শে আসে এবং তার ফলে বাংলা সাহিত্যের বিচিত্র বিকাশ হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে অনুবাদ শাখার সংখ্যাগত গৌরব কিঞ্চিৎ খর্ব হলেও মহাভারতের অনুবাদক কাশীরাম দাস একাই সমগ্র শতাব্দীর মানদণ্ড হিসেবে বিরাজ করেছেন। যদিও এই শতাব্দীতে সমগ্রভাবে অনুবাদ শাখার গুণগত উৎকর্ষ খুব চিত্তাকর্ষক হতে পারেনি, পুরাতনের পুনরাবৃত্তি চলেছে অলসভাবেতবুও তারই মাঝে কাশীরাম দাস তার প্রতিভার স্ফূরণে নিজ নাম ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত করতে পেরেছেন। আর তাই যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণা বাঙালী সেই অনুবাদের রসাস্বাদন করে চলেছেন অক্লেশে। কেননা—

মহাভারতের কথা অমৃত সমান।

কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।

কৃত্তিবাসের সঙ্গে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে, যিনি বাঙালির কাছে নিত্যস্মরণীয়, যার কাব্য প্রতি সন্ধ্যায় প্রদীপের অনুজ্জ্বল আলোয় গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বা গৃহস্থ বাড়ির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ধর্মপ্রাণা পুরুষ মহিলার সারাদিনের কর্মক্লান্তির লেশ মিটায়, মনে জোগায় স্বর্গীয় প্রেরণাতিনি হলেন মহাভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুবাদক কায়স্থবংশীয় কাশীরাম দাস। তাঁর পৈতৃক উপাধি ছিল দেব। হিন্দী ভক্তকবি তুলসীদাস রামায়ণ অবলম্বনে সুবিখ্যাত রামচরিতমানসরচনা করে ভক্তের হৃদয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন, কিন্তু মহাভারত নিয়ে সেরকম কোন প্রাদেশিকভাষী কবির আবির্ভাব হয়নি। সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্য ভাগ্যবান। মহাভারত মহাসাগর সন্তরণ করা অতি দূরূহ, বিশেষতঃ বাংলার মতো প্রাদেশিক ভাষায়। সেই বিশালকায় মহাগ্রন্থকে কবি কাশীরাম দাস বাঙালির উপযোগী করে নতুন রূপ দিয়েছিলেন। তাই এই কায়স্থ কবিকে বাংলার ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণেরাও মহাসম্মানে শিরোধার্য করেছেন।

কাশীরামের কুলপরিচয় ও রচনাদি নিয়ে একসময় বেশ সমালোচনা হয়েছিল। যদিও কাশীরাম দাস কৃত্তিবাসের অনেক পরবর্তী কালের কবি, তবু তার কুলপরিচয় নিয়ে কৃত্তিবাসের মতোই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। কবি মহাভারতের অনুবাদে দুএক স্থানে নিজের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত উক্তি করেছেন। তার অগ্রজ-অনুজেরাও কবিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাদের কাব্য থেকেও কাশীরাম সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এ সমস্ত বর্ণনা থেকে তার বংশধারা ও কাব্যরচনাদি সম্বন্ধে এই ধরণের সামান্য কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কাশীরামের কোন কোন পুঁথিতে নন্দরামের ভনিতা আছে। কবির গুরু অভিরাম মুখোটির উপদেশে কবি মহাভারতের পাঁচালী রচনায় প্রবৃত্ত হন। কাশীরামের দুএকখানি পুথিতে সন তারিখ জ্ঞাপক পয়ারের নির্দেশ আছে। তা থেকে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ১৬০৪ ও ১৬০২-০৩ খ্রীষ্টাব্দের ইঙ্গিত পেয়েছেন। ১৬৭৮ খ্রীষ্টাব্দে নকল করা কাশীরাম দাসের মহাভারতের একখানি পুথি পাওয়া গেছে। এ তারিখে কোন ভুল না থাকলে আমরা অনুমান করতে পারি, ষোড়শ শতাব্দীর একেবারে শেষে বা সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় কাশীরাম মহাভারত অনুসরণে  ভারত পাঁচালীরচনায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাশীরামের একখানি পুথিতে ১০০২ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৫৯৫ খ্রী: অব্দে পাওয়া যাচ্ছে, আর একখানি পুথিতে ১০২০ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৬১৩ খ্রী: অব্দ আছে। তাই আমাদের মনে হয়, কবির কাব্য ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকেই রচিত হতে পারে ৷ কাশীরাম দাস সমগ্র মহাভারতের অনুবাদ করেছিলেন কিনা তা নিয়ে সমালোচকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারণ কাশীরামদাসের কোন কোন পুথিতে আছে যে,

আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।

ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুথিশালায় কাশীরামের কোন কোন পুথিতে এই উক্তি লক্ষ্য করা যায়। সেখানে আরো উল্লেখ আছে যে, মৃত্যুকাল নিকটবর্তী দেখে কাশীরাম তার ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরামের উপর অসমাপ্ত কাব্য সমাপ্ত করার ভার দিয়ে যান। আবার কবির কনিষ্ঠ ভ্রাতা গদাধর বলেছেন যে তার অগ্রজ কাশীরাম গোটা মহাভারত রচনা করেন দুএক পর্ব নয়। এ বিষয়ে মহামোহপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ প্রভৃতি কাশীরাম বিশেষজ্ঞগণ স্বীকার করেছেন যে, কাশীরাম মাত্র চারটি পর্ব রচনা করে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার বংশের সকলেই অল্পাধিক কবিপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাই তার ভ্রাতৃপুত্র, জামাতা বা আর কেউ মহাভারতের আর চোদ্দটি পর্ব রচনা করে কাশীরামের কাব্যের পূর্ণতা সাধন করেন। সেই সমস্ত পর্বের অধিকাংশ স্থলেই কাশীরামের ভনিতা নেই। প্রথম চার পর্ব তার একহাতের রচনা বলে তার বাঁধুনি প্রশংসনীয়, রচনাও মোটামুটি এক ধরণের। কিন্তু তার পরের পর্বগুলি বিভিন্ন লোকের রচনা বলে তাতে নানা ত্রুটি, অসঙ্গতি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কৃত্তিবাসের রামায়ণে অনেক অংশে পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত হলেও মোটামুটি কাব্যটি একই হাতের রচনা। কিন্তু কাশীরাম দাসের মহাভারত সম্বন্ধে সে কথা বলা যায় না। সে যাই হোক নানা অসঙ্গতি সত্ত্বেও কাশীরাম দাস যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তা এক কথায় অপূর্ব।

অনেক সমালোচক বলেছেন যে, সংস্কৃতে অজ্ঞানতা হেতু মহাভারত অনুবাদ কালে তিনি কথকের মুখ থেকে মহাভারতের গল্প শুনে তা পয়ার ত্রিপদী ছন্দে রচনা করেছিলেন। কিন্তু মূল সংস্কৃত মহাভারতের সঙ্গে অনুবাদ মিলিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, কবি যে ভালই সংস্কৃত জানতেন তা তার অনুবাদেই প্রমাণিত। মহাভারতের সংস্কৃত শ্লোক যেভাবে তিনি বাংলা পয়ার ত্রিপদীতে রূপান্তরিত করেছেন—তাতে তাকে সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ পারদর্শী বলেই মনে হয়। তা ছাড়া তার ভাষা, শব্দপ্রয়োগ ও তালংকার ব্যবহার এতই সংস্কৃত ঘেঁষা যে, এ ভাষায় তার বিশেষ অধিকার ছিল তা মানতেই হবে। উদাহরণস্বরূপ কৃষ্ণের বিশ্বরূপ বর্ণনা পর্যায়ের একটি রচনা অনুধাবনযোগ্য:

সহস্র মস্তক শোভে সহস্র নয়ন ।

সহস্র মুকুটখানি কিরীট ভ্রমণ ।।

সহস্র শোভনে শোভে সহস্র কুণ্ডল।

সহস্র নয়নে রবি সহস্র মণ্ডল ।।

এ রচনা যেন গীতায় অর্জনের বিশ্বরূপ দর্শনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু তার রচনায় আবার কয়েকস্থলে কৃত্রিমতার ছোঁয়াও পরিলক্ষিত হয়। দুর্যোধন কন্যা লক্ষ্মণার রূপ বর্ণনায় সেই কৃত্রিমতা লক্ষণীয় ।

অনুপম মুখ তার যিনি শরদিন্দু।

ঝলমল কুন্তল কমল প্রিয়বন্ধু ।।

 সম্পূর্ণ মিহির যিনি তার রঙ্গিমা।

ভ্রূভঙ্গ অঙ্গজ চাপ জিনিয়া ভঙ্গিমা ।।

সে যাই হোক অবশ্য এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, তিনি সংস্কৃতে অজ্ঞ ছিলেন।

অনুবাদের ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব পর্যালোচনায় বলা যায় যে, মহাভারতের প্রথম চার পর্বে কবি সংক্ষেপে মূল কাহিনী অনুসরণ করেছেন, দু-একটি স্থলে দুএকটি আখ্যান তিনি নিজে বানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু রচনার গুণে বানানো কাহিনীও মূলের অনুবাদ বলেই মনে হয়। মধ্যযুগের সব অনুবাদকের মতো কাশীরাম মহাভারতের মূলের আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ করেছেন বলা চলতে পারে। কবি প্রসন্ন ভঙ্গিতে, পরিচ্ছন্ন ভঙ্গিতে কাহিনীটি বিবৃত করেছেন, কোথাও কোথাও তত্ত্ব ও নীতিকথাগুলিকে প্রায় হুবহু অনুবাদ করেছেন। তার বর্ণনা বেশ সরস ও গতিযুক্ত হলেও উত্তর চৈতন্যযুগের প্রভাবে ভাষার মধ্যে তৎসম শব্দ, বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ, সমাস সন্ধির কিছু বাড়াবাড়ি ও আলংকারিক অতিরেক দেখা যায়। যার ফলে তার ভাষা ও রীতি মাঝে মাঝে কিঞ্চিৎ শিথিল হয়ে পড়েছে। কৃত্তিবাসের মতো গ্রামীণ সরলতা তার ভাষার বহু স্থলেই লক্ষ্য করা যায় না। উপরন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাঙালী জীবন ও সমাজের এত বেশী ছাপ পড়েছে যে, রামকাহিনী বাঙালীর ঘরের সামগ্রী হয়ে গেছে। কাশীদাসী মহাভারতে ঠিক সেরকম বাঙালীয়ানা দেখা যায় না। তবে কাশীরামের বিনয়াবনত বৈষ্ণব মনটি রচনার মধ্যে অকৃত্রিম ভাবে ধরা পড়েছে। ভক্তবংশে যে তার জন্ম হয়েছিল, তা তার রচনা থেকেই বোঝা যায়। এদিক থেকে উত্তর চৈতন্য যুগের ভক্তির ধারা তার হৃদয়কে গভীরভাবে প্লাবিত করেছিল। অনুবাদ সাহিত্যের ধারায় কাশীরামদাস যে বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী ছিলেন তা ধরা যায় পরবর্তীকালে অনেক স্বল্পখ্যাত রচনাকারের রচনায় কাশীরামের নাম ব্যবহারে। কত কাল ধরে নানা পরিবর্তন সাহিত্যের ক্ষেত্রে সূচিত হলেও এখনও পর্যন্ত কাশীরামের মহাভারত সমান জনপ্রিয়তা বজায় রেখে চলায় আমরা নিঃসন্দেহে একটি কথাই বলতে পারি যে কাশীরামের মহাভারতই কাশীরামের জনপ্রিয়তার এক এবং অন্যতম কারণ। আর তাই কবি মধুসূদনের মূল্যায়নটিকে যথার্থ বলে মনে হয়—

মহাভারতের কথা অমৃত সমান ।

হে কাশী, কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান ।।