-->

নবনাট্য আন্দোলন : গণনাট্য

নবনাট্য আন্দোলন : গণনাট্য

 নবনাট্য আন্দোলন : গণনাট্য

সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সাহিত্যের রূপ ও ভাবনার অনিবার্যতা অস্বীকার করা যায় না। উনিশ শতকের মধ্যপর্বে বাংলা নাটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর অতিক্রান্ত হয়েছে অনেকগুলি বছর। ইতিমধ্যে বিশ্বের তথা বাঙালির জীবনে ঘটেছে নানা আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন। রাজনৈতিক পটভূমিরও পরিবর্তন ঘটেছে সেই সঙ্গে। তাই বাংলা নাটকের ইতিহাসকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়। এই ভাগ যুগানুযায়ী লক্ষণ বিচারে এবং রঙ্গমঞ্চ নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে। তিনটি পর্বকে এইভাবে চিহ্নিত করা যায়—(১) উদ্ভব থেকে জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা (১৭৯৫-১৮৭২), (২) জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার পর থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ পর্যন্ত (১৮৭২-১৯৩৯), (৩) দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী চলমান কাল (১৯৩৯......)।

আলোচ্য পর্বগুলির দ্বিতীয় পর্বে বাংলা নাটকের বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, উপস্থাপনা প্রভৃতিতে বিপুল পরিবর্তন আসে। বাংলা নাটকের প্রথম পর্বে পেশাদারিত্বই ছিল উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মঞ্চ সাফল্যের দিকে দৃষ্টি রেখে পুরাণ, ইতিহাস এবং সমকালীন সমাজ সমস্যামূলক প্রচুর নাটক লেখা হয়েছে। এই পর্বে,স্বদেশী চেতনা, ধর্মীয় চেতনাই ছিল প্রধান নাট্যবস্তু। তাছাড়া সমসাময়িক সমাজ-বিকৃতিও ছিল এই পর্বের নাটকীয় উপাদান।

দ্বিতীয় পর্বেও ঐতিহাসিক, সামাজিক, রোমান্টিক নাটক এবং প্রহসন রচিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলির ভাব-ভাবনার মধ্যে ভিন্নতা দেখা গেল। ঐতিহাসিক নাটক প্রসঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছেন—“কি উপায়ে দেশের প্রতি লোকের অনুরাগ ও স্বদেশপ্রীতি উদ্বোধিত হইতে পারে । শেষে স্থির করিলাম নাটকে ঐতিহাসিক বীরগাথা ও গৌরব কাহিনী কীৰ্তন হয়ত কতকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে।অবশ্য বিষয়বস্তুর পুচ্ছগ্রাহিতা এবং নাট্য ব্যবসায়ীগণের ফরমায়েশী রচনা দর্শকদের ক্লান্তির কারণ হয়েছিল।

তৃতীয় পর্বে বিশ্বের তথা ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পটভূমির বিরাট পরিবর্তন ঘটল। ইতিমধ্যে রাশিয়ায় জয়ী হয়েছে বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭)। যদিও তখনও এই বিপ্লবের সাফল্যের প্রভাব ভারতে বিশেষ পড়েনি। ১৯২৭-২৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে জন্ম নিয়েছে ছাত্র ফেডারেশন। ধীরে ধীরে প্রচলিত রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়তে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে লেখক, কবি ও শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিবাদী কণ্ঠ সরব হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের ইস্তাহারে সাহিত্য ও শিল্পের নূতন চিন্তাধারা ঘোষিত হল। ঐ ইস্তাহারে বলা হয়েছে—“ভারতের নবীন সাহিত্যকে বর্তমান জীবনের মূল সমস্যা ক্ষুধা, দারিদ্র্য সামাজিক পরান্মুখতা, রাজনৈতিক পরাধীনতা নিয়ে আলোচনা করতে। যা কিছু আমাদের নিশ্চেষ্টতা অকর্মণ্যতা, যুক্তিহীনতার দিকে টানে তাকে আমরা প্রগতিবিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করি। যা কিছু আমাদের বিচারবুদ্ধিকে উদ্বুদ্ধ করে, সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতিকে যুক্তিসম্মতভাবে পরীক্ষা করে, আমাদের কর্মিষ্ঠ শৃঙ্খলাপটু সমাজের রূপান্তরক্ষম তাকে আমরা প্রগতিশীল বলে গ্রহণ করব।

১৯৩৬ সালে এই আদর্শ সামনে রেখেই প্রতিষ্ঠিত হয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘ। এই হল গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের প্রেক্ষাপট।

গণনাট্য আন্দোলনের সূচনা কি, কোথায়, কবে হয়েছিল সে সম্পর্কে মতভেদ আছে। অধিকাংশ গবেষক মনে করেন, এই আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল বাংলার বাইরে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে; বোম্বাই এবং বাঙ্গালোরে গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে জানা যায়। গণনাট্য সঙ্ঘ নামে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে ১৯৪১ সালে বাঙ্গালোরে। অনিল ডি সিলভা নামে একজন মহিলার উদ্যোগেই সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা। তাঁরই আগ্রহে গড়ে ওঠে পিপলস থিয়েটার। তার ভারতীয় নাম হয় গণনাট্য সঙ্ঘ। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসের সময়ে সর্বভারতীয় সংগঠন হিসাবে গণনাট্য সঙ্ঘের স্বীকৃতি। বাংলাদেশে ১৯৪২ থেকেই জননাট্য সঙ্ঘের বিকাশ ঘটতে থাকে। তারপর ১৯৪৩-এ গণনাট্য সঙ্ঘের জন্ম। এই জন বা গণনাট্য সঙ্ঘ প্রথম থেকেই ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘের শাখারূপেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অন্যদিকে ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘ প্রগতি লেখক সঙ্ঘের অনুবর্তনেই গঠিত।

বাংলাদেশে তথা ভারতে অতি প্রাচীনকাল থেকেই গ্রাম্য মানুষের আনন্দ উপভোগের উপকরণ ছিল লোকনাট্য। গণনাট্যনামকরণটিতে লোকনাট্য প্রভাবের কথা অবশ্যই উল্লেখ্য। এছাড়াও ভাবসাদৃশ্যও যথেষ্ট। গণনাট্যের ভিত্তি হল সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ, আঘাত সংঘাতের ইতিকথা। অনিবার্যভাবেই অর্থনৈতিক অসমবণ্টন শোষিত মানুষের ক্ষোভ দানা বাঁধে এবং প্রতিবাদ প্রতিশোধে মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশ স্পর্শ করে। এই অসাম্য অবিচারের বিরুদ্ধে এমন সংগ্রাম ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই তারা চায় সংঘবদ্ধ হতে। অন্ধভাববাদী মানসিকতা পরিত্যাগ করে। পৃথিবীর বিরূপতাকে উপেক্ষা করে এবং মানুষের পৈশাচিক লোভ ও স্বার্থপরতার প্রতিবাদ জানিয়ে একটির পর একটি কাহিনী চিত্রিত হয়েছে গণনাট্যে

নবনাট্য ও গণনাট্য সংক্রান্ত বিতর্কে না গিয়ে গঙ্গাপদ বসুর বক্তব্যকে অনুসরণ করে বলা যায়—‘সৎ মানুষের নতুন জীবন বোধের এবং নতুন সমাজ ও বলিষ্ঠ জীবন গঠনের মহৎ প্রয়াস যে সুলিখিত নাটক শিল্প সুষমায় প্রতিফলিত, তাকেই বলতে পারি নবনাট্যের নাটক। সংক্ষেপে গণনাট্যের সংজ্ঞাটি নিম্নরূপ

যে নাটক শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত অদৃষ্টব্যাপী সাধারণ মানুষের আত্মরক্ষার প্রয়োজনেচেতনা পরিবর্তনের ফলেঅসাম্প্রদায়িক সঙ্ঘবদ্ধ গণজাগরণ এবং সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সার্বিক প্রয়াস ও সম্ভাব্য জয়ের ইঙ্গিত পরিস্ফুটসে নাটককে বলা যায় গণনাট্য।'

এই জাতীয় চিন্তাধারার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল

(ক) শ্রমিক কৃষক ও সাধারণ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষকে অধিকার সচেতন করা এবং বৈপ্লবিক চেতনার সঞ্চার করা।

(খ) কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, অদৃষ্টবাদ প্রভৃতির বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্ত করা।

(গ) সাম্যবাদী পার্টিকমিউনিস্ট পার্টির বৈপ্লবিক চেতনাকে সাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত করতে নান্দনিক প্রচার।

(ঘ) মানুষের দাসবৃত্তি এবং হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি দেওয়া। বিজন ভট্টাচার্যের নবান্নতুলসী লাহিড়ীর আগুন’, ‘জবানবন্দীপ্রভৃতি গণনাট্যের নাট্যফসল। নাটকগুলির বিষয়বস্তুতেই নূতন কালের ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে।