-->

বাংলা নাট্যসাহিত্যে বিজন ভট্টাচার্যের অবদান

 নাট্যকার বিজনভট্টাচার্য

গিরিশযুগ ও দ্বিজেন্দ্রযুগের পরবর্তীকালে বাংলা নাটকের বিষয় ও উপস্থাপনার মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন পরিস্ফুট হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথের নাটক যদিও সর্বকালের মধ্যেই ব্যতিক্রমী, তথাপি বাংলা নাটকে আধুনিকতার অনুরণন জাগাল রবীন্দ্র-নাটক। অন্যদিকে ১৯৩০ থেকেই দুই বিশ্বযুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীর নৈতিক, রাষ্ট্রিক, সামাজিক, ধর্মীয় মূল্যবোধের উত্থানপতন গভীরভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করল সমকালীন সাহিত্যধারাকে। বাংলা নাটকও পরিবর্তনের স্রোতে উপেক্ষিত রইল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সর্বাত্মক ধ্বংসমুখীনতার মধ্যে অন্যদিকে ৪২-এর আগস্ট আন্দোলনের পটভূমিতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয়ী সমস্যার প্রজ্বলনকে বুকে নিয়ে ভূমিষ্ঠ হল নবনাট্য আন্দোলনের দিশারী বিজন ভট্টাচার্যের নাটক নবান্ন’ (১৯৪৪)। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭-এর মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রভাবে এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যায় যখন ভারতবর্ষ কণ্টকিত, তখন বাংলা নাট্যজগতেও দেখা দিয়েছিল অবসাদ ও অবক্ষয়ের প্রতিকূলতা। ভাল নাটক এবং উৎকৃষ্ট অভিজ্ঞতার অভাবে বাংলা নাটকের আকর্ষণ একেবারেই তিরোহিত হচ্ছিল। নাট্যশালাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারে এমন নাটকের একান্ত অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল। জগতের মহাসঙ্কট ও দুর্গতির মুহূর্তে দেশকে উজ্জীবিত করতে নাটক বরাবরই একটি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। ক্ষয়িষ্ণু ও মুমূর্ষু সমাজের সামনে বিভেদ, শোষণ, অত্যাচার, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির প্রতিবাদে শুরু হল নবনাট্য আন্দোলন। দেশের সাধারণ মানুষকে, গ্রামীণ মানুষকে নতুন প্রেরণার সন্ধান দিল এই নাট্য আন্দোলন।

বাংলা নাটকে নতুন ধারা :

যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা, ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব, দুর্ভিক্ষ এসবই এই ধারার নাটকের মূল উপজীব্য হয়ে উঠল। এছাড়া নাটকের আঙ্গিক ও প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এই নাট্যধারা চিরাচরিত রীতির পরিবর্তন ঘটাতে অগ্রসর হল। মঞ্চসজ্জা, আলোর ব্যবহারেই শুধু নয়, সংলাপ রচনায়, সঙ্গীতের প্রয়োগে, চরিত্রসজ্জাতেও এই নতুনত্ব পরিস্ফুট হল। একটি দুটি প্রধান চরিত্রের অপেক্ষা অনেক চরিত্র নিয়ে একটা টিমওয়ার্কের সাফল্যই নাটকের সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হল। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ এবং বিভিন্ন অপেশাদার প্রগতিমূলক নাট্যগোষ্ঠীগুলিই এই নতুন নাট্যধারার বাহক হয়ে উঠল। জনজীবনে নতুন উদ্ভূত সমস্যাগুলিকে অবলম্বন করে এই ধারায় যে নাটকগুলি রচিত হল তাদের মধ্যে অন্যতম নবান্ন’, ‘ছেঁড়া তার’, ‘দুঃখীর ইমানপ্রভৃতি। যুদ্ধ এবং দেশবিভাগের ফলে বাঙালি জীবনের বিধ্বস্ত রূপটি হল নতুন ইহুদি’, ঋত্বিক ঘটকের দলিল’, দিগেন চট্টোপাধ্যায়ের বাস্তুভিটাপ্রভৃতি নাটকে। নবনাটকের নাট্যকাররা যে শুধু জীবনের বিপর্যয় আর তার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে চিত্রিত করলেন তা নয়, সেইসঙ্গে সংকট মুক্তির পথটিও নির্দেশ করছিলেন সংঘবদ্ধ সাম্যময় সমাজতান্ত্রিক জীবনচর্যার মধ্যে। এই পর্বের নাট্যকারের মধ্যে সর্বপ্রথম স্মরণীয় বিজন ভট্টাচার্য। বস্তুত তাঁকেই বলা যায় এই ধারাটির জনক। বিজন ভট্টাচার্য খুবই কমসংখ্যক নাটক রচনা করেছেন তবে তাঁর প্রথম নাটক নবান্নকেই বাংলা নবনাট্য আন্দোলনের সূচকরূপে গণ্য করা হয়। শুধু বিষয়বস্তুর অভিনবত্বেই নয়, মঞ্চ আঙ্গিকের নতুনত্বে এই নাটক সনাতন বাংলা নাটকের ধারায় পরিবর্তন এনেছিল।

বাংলা নবনাট্যের ধারা ও বিজন ভট্টাচার্য :

বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক অবশ্য জবানবন্দী। এ নাটকে দুর্ভিক্ষকবলিত কৃষক পরিবারের ছবিই অঙ্কিত। তবে এই সমস্যার আরও সার্থক চিত্ররূপায়ণ ঘটে নবান্ন’-র মধ্যে। ঊনবিংশ শতাব্দীর নাটক নীলদর্পণের পরে এমন ব্যাপক প্রভাবিস্তারী নাটক বাংলা নাট্যধারায় প্রায় বিরল। যুদ্ধ এবং মন্বন্তর বাংলার কৃষকসমাজকে কিভাবে বিধ্বস্ত করেছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নৈতিকতার দিক থেকে, তার সজীব চিত্রণ নবান্ন। এই নাটকের পটপ্রেক্ষা বিন্যস্ত গ্রাম ও শহরের জীবনভূমিতে। নবান্নের লক্ষ্মীকে বরণ করাই গ্রামবাংলার কৃষকের সারা বছরের পরিশ্রমের একমাত্র লক্ষ্যবিন্দু, এ নাটকে রয়েছে আমিনপুরের কৃষককুল সেই নবান্ন সমারোহের বিপ্রতীপ ছবি। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অসৎ ব্যবসায়ীর লোভ এই কৃষকসমাজকে নবান্নের উৎসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। গ্রাম ছেড়ে শহরের পথে জন্তুর সঙ্গে খাদ্য আহরণের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় আমিনপুরের কৃষকরা। বড়কর্তা, হারুদত্ত, কালীধন, রাজীবএইসব চরিত্ররাই মনুষ্যত্বের এই অবমাননাকে বাস্তব করে তোলে। নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্ৰ করেই আবার আমিনপুরে সংঘবদ্ধ হয় নিরঞ্জন-বিনোদিনী, কুঞ্জ, রাধিকা, প্রধান প্রমুখেরা। নবান্ন এখানে নতুন জীবনবোধ, নবপ্রাণনার প্রতীকরূপে ব্যঞ্জিত হয়। আমিনপুরের কৃষকদের আঞ্চলিক ভাষানির্ভর সংলাপ, অন্যদিকে কলকাতার পটভূমিতে স্ট্যান্ডার্ডভাষার ব্যবহার নাটকে এমন এক বাস্তবতার সঞ্চার করে যা বাংলা নাটকের প্রচলিত ধারায় প্রায় দুর্লভই ছিল বলা যায়। এতদিন পর্যন্ত বাংলা নাটকের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান ছিল সঙ্গীত, অনেক সময়ে অপ্রয়োজনেও সঙ্গীতের সংযোজনা চোখে পড়ে। পঞ্চাশের দশকের মন্বন্তর কবলিত আমিনপুরের ভয়াবহ নিরস প্রেক্ষাপটে সঙ্গীত সংযোজনার কোন অবকাশই ছিল না। তথাপি বিজন ভট্টাচার্য প্রচলিত নাট্যসংস্কারকে অনুসরণ করে চতুর্থ অঙ্ক থেকে তিনটি সঙ্গীত যোজনা করেছেন। তবে এ নাটকে কিছু শিল্পগত ত্রুটি থেকেই গেছে। যেমন এক একটি দৃশ্যের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকে নাট্যকার অতিক্রম করতে পারেননি। নিরঞ্জন-বিনোদিনীর সাক্ষাৎ, তাদের গ্রামে ফিরে আসা, কুঞ্জর ও রাধিকার গ্রামে প্রত্যাবর্তন, আকস্মিকভাবে সকলের মিলন নাটকের ঘটনার গতিকে ব্যাহত করে, বাস্তবতাকেও কিছুটা ক্ষুণ্ণ করে।

‘নবান্ন’ রচনার বেশ কিছুদিন পরে বিজন ভট্টাচার্য রচনা করেছিলেন গোত্রান্তর’ (১৯৬০)। একজন উদ্বাস্তু স্কুল-শিক্ষক সপরিবারে কিভাবে ভদ্র মধ্যবিত্ত জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে বস্তিগামী শ্রমিকজীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়লেন তারই কাহিনী এখানে বর্ণিত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় নাটকে এই গোত্রান্তর সম্ভব হল শিক্ষক-কন্যার সঙ্গে শ্রমিক-যুবক কানাই-এর বিবাহের মধ্যে। এ নাটকেরও সমাপ্তি তথা সমস্যার সমাধান ঘটানো হয়েছে আকস্মিকভাবে। নাটকের শৈলী চরিত্রটিকে সমালোচকরা গোর্কীর মা’-এর সঙ্গে তুলনীয় মনে করেন।

বিজন ভট্টাচার্য খুব বেশি সংখ্যক নাটক রচনা করেননি। বাংলা নাট্যধারার ইতিহাসে ‘নবান্নর রচয়িতা রূপেই তিনি স্মরণীয়। নবনাট্য আন্দোলনের পথপ্রদর্শকরূপে বিজন ভট্টাচার্য আজ প্রবাদপ্রতিম। যদিও নাট্যকুশলতায় হয়তো কিছু ত্রুটি তাঁর থেকেই গেছে। তথাপি সাম্প্রতিক নাটকের চলমান ধারাটিকে প্রথম প্রাণময় করে তোলার কৃতিত্ব তাঁরই প্রাপ্য।