বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এবং একটি পর্যায় নিয়ে আলোচনা (পূর্বরাগ)
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ এবং একটি পর্যায় নিয়ে আলোচনা (পূর্বরাগ)
‘যদি হরি স্মরণে মন সরস হয়,
যদি বিলাস কলায় কৌতূহল থাকে,
তবে জয়দেব কৃত বাণী কোমলকান্ত
পদাবলী শ্রবণ কর।’
ভারতে বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন কালে অনেক পদই রচিত হয়েছে, তবে বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই পদ একটি বিশেষ মাত্রা লাভ করেছে। খ্রি: দ্বাদশ শতকে জয়দেব গোস্বামী রচিত ‘গীত গোবিন্দ’ কাব্যেই রাধাকৃষ্ণ লীলা-সম্পর্কিত পদ রচিত হয় এবং এখানেই সম্ভবত প্রথম ‘পদাবলী’ শব্দটিরও ব্যবহার হয়। কিন্তু এখানেই এর আরম্ভ নয়—তাত্ত্বিকগণ খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকের প্রথম দিকেই অনুরূপ কাব্য ধারার অস্তিত্ব লক্ষ করেছেন এবং পদ শব্দটি ছিল আরও পূর্ববর্তীকালের। ভরতের নাট্যসূত্রে (খ্রিঃ পূঃ ২শতক-খ্রিঃ ২শতক) ‘পদ’ শব্দটি বাক্য ও সঙ্গীত দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল। কালিদাস ‘মেঘদূত’ কাব্যে সঙ্গীত অর্থে ‘পদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। প্রাচীন সঙ্গীতশাস্ত্রে সঙ্গীত অর্থে ‘পদ’ শব্দের ব্যবহারের দৃষ্টান্ত মেলে। মহামোহপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রাপ্ত বৌদ্ধ সাধন সঙ্গীতের নাম ‘চর্যাপদ’। বাংলা ভাষাতেও গান অর্থে ‘পদ’ শব্দের ব্যবহার বহু প্রাচীন। আচার্য দণ্ডী পদসমুচ্চয় অর্থে পদাবলীর প্রথম ব্যবহার করেছেন তাঁর ‘কাব্যাদর্শ’ গ্রন্থে। তবে সঙ্গীত শ্লোক অর্থে প্রথম পদাবলী কথাটি ব্যবহার করেছিলেন জয়দেব গোস্বামী তাঁর গ্রন্থে।
সুদীর্ঘকাল থেকেই ভারতে প্রেম কবিতা রচনার একটি ধারা চলে এসেছে। বিভিন্ন সংস্কৃত-প্রাকৃত-প্রকীর্ণ কবিতায় এর সন্ধান পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কৃষ্ণ-রাধা এবং গোপীদের উল্লেখ রয়েছে, আবার এদের সঙ্গে কখনও কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু সর্বত্রই ভাবটি একান্তভাবেই মানবিক এবং লৌকিক। হরিবংশ-বিষ্ণুপুরাণাদি গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলা-কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তা’ও একান্তভাবে লৌকিক ভাবাপন্ন। এই লৌকিক প্রেমের ধারাই দীর্ঘকাল স্বচ্ছন্দ গতিতে প্রবাহিত হতে হতে এক সময় এসে রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছে। যিনি বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের প্রথম পুরুষ রূপে অভিহিত, সেই জয়দেব গোস্বামীর রচনাতেও লৌকিক প্রেমের ইঙ্গিত রয়েছে। প্রাচীন ভারতের এই লৌকিক প্রেম কবিতার ঐতিহ্যই যে কালে কালে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে পরিণতি প্রাপ্ত হয়েছে এ বিষয়ে সমালোচকেরা একমত পোষণ করেছেন।
পদাবলী সাহিত্যের উদ্ভব, ধারাবাহিক ভাবে রাধাকৃষ্ণের কাহিনি বর্ণনা এবং সচেতন ভাবেই রাধাকৃষ্ণকে অবলম্বন করে পদ রচনার শুরু জয়দেব গোস্বামী থেকেই। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মহাজনেরা পদাবলীর ভাষা ছন্দ অলঙ্কার—মূল বিষয় বস্তুতে যেমন জয়দেবকে অনুসরণ করেছেন পদাবলী নামটিও তেমন আত্মসাৎ করেছেন বলা যেতে পারে। বৈষ্ণব ধর্ম ও বৈষ্ণব পদাবলীর একটি ধারা চৈতন্যদেবের জন্ম থেকে প্রবলরূপ ধারণ করেছিল। চৈতন্যজীবনী থেকে জানা যায় চৈতন্যদেব নিজে বৈষ্ণব পদের রস আস্বাদন করতেন, চৈতন্যজীবনীকার বলেছেন—
“চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি রাঢ়ের নাটকগীতি
কর্নামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ
স্বরূপ দামোদর সনে মহাপ্রভু রাত্রি দিনে
গায় শুনি পরম আনন্দ।
চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগে বর্তমান ছিলেন। মিথিলার বিদ্যাপতি ঠাকুর জয়দেবকে অনুসরণ করেই রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় কবির ‘অভিনব জয়দেব’ উপাধি গ্রহণে। সংস্কৃত, মৈথেলি কিংবা বাংলা নয়—একটি অপভ্রংশ জাত কৃত্রিম ভাষায় তিনি পদ রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষায় চণ্ডীদাসই রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ রচনার পথ প্রদর্শন করেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’ রচনার মাধ্যমে। তবে চৈতন্যজীবনীতে উল্লেখিত চণ্ডীদাস ইনিই কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বলা হয় পদাবলীর চণ্ডীদাস পৃথক ব্যক্তি, তাঁর নাম দ্বিজ চণ্ডীদাস।
বৈষ্ণব পদাবলী চৈতন্য পূর্ববর্তীকালে সূচনা হলেও তার সৃষ্টি ও পুষ্টি সাধন ঘটেছিল বস্তুত চৈতন্য সমকাল ও চৈতন্য উত্তরকালেই। বৈষ্ণব পদাবলী ভিন্ন মাত্রা লাভ করে চৈতন্য পরবর্তী পদাবলীকারদের রচনায়। গোবিন্দদাস ও জ্ঞানদাস তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক নানা প্রকার তত্ত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণিত হয়েছে বৈষ্ণব পদকর্তাগণ এ সকল তত্ত্বের পরিপোষকতায় পদ রচনা করে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলী প্রধানত মধুর রসের বা শৃঙ্গার রসের কাব্য। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে শ্রীরূপ গোস্বামী শৃঙ্গার রসের দুটি ভাগ কল্পনা করেছেন। মধুর রসের বৈচিত্র্য দুই প্রকার—
ক. বিপ্রলম্ভ (পূর্বরাগ, মান, আক্ষেপানুরাগ, প্রবাস বা বিরহ)।
খ. সম্ভোগ (ভাবসম্মেলনাদি)।
পূর্বরাগ :
প্রিয় বা প্রিয়ার প্রতি যে প্রাথমিক আকর্ষণবোধ, যাকে দেখে ভালো লাগে, যার বিষয়ে শুনলে মনে আনন্দের সঞ্চার হয়, যার সঙ্গে পুনর্বার সাক্ষাতের আকাঙ্খা জাগে তাকেই পূর্বরাগ বলা হয়। ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে শ্রীরূপ গোস্বামী পূর্বরাগের সংজ্ঞায় বলেছেন—
“রতিরজা সঙ্গমাৎ পূর্বং দর্শন-শ্রবণাদিজা,
ত্য়োরুন্মীলিত প্রাজ্ঞৈ পূর্বরাগঃ স উচ্যতে। । ’’
‘যে রতি মিলনের পূর্বে দর্শন ও শ্রবণাদি দ্বারা উৎপন্ন হয়ে নায়ক নায়িকা উভয়ের হৃদয়কে উন্মীলিত করে, তারই নাম পূর্বরাগ।’
শ্রীরূপ গোস্বামী পূর্বরাগকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন—
ক. দর্শন-জাত পূর্বরাগ
খ. শ্রবণ-জাত পূর্বরাগ
দর্শন-জাত পূর্বরাগ তিন প্রকার—
অ. সাক্ষাৎ দর্শন
আ. চিত্রপটে দর্শন
ই. স্বপ্ন দর্শন
শ্রবণ-জাত পূর্বরাগ পাঁচ প্রকার—
অ. বন্দি মুখে শ্রবণ
আ. দূতী মুখে শ্রবণ
ই. সখি মুখে শ্রবণ
ঈ. গুণীজনের মুখে শ্রবণ
উ. বংশী ধ্বনিতে শ্রবণ।
পূর্বরাগের কয়েকটি পদ নিচে তুলে ধরা হল—
বিদ্যাপতি—
“মাধব পেখল অপরূপ বালা।
সৈসব জৌবন দুহু এক ভেলা।।’’
চণ্ডীদাস—
“সই কে বা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।।’’
জ্ঞানদাস—
“রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।’’
জ্ঞানদাস শ্রীকৃষ্ণের পূর্বরাগের বর্ণনা করেছেন—সেগুলি ব্রজবুলি ভাষা।