-->

মুক্তক ছন্দ ।। বলাকার ছন্দ

 
মুক্তক ছন্দ ।। বলাকার ছন্দ

মুক্তক ছন্দের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

বাংলা ছন্দের প্রবহমানতার পথিক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তার ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দের মধ্য দিয়ে বাংলা ছন্দের মুক্তি ঘটেছে। এই ধারাতেই পরবর্তীকালে এসেছে গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘গৈরিশ ছন্দ’ এবং তার পরেই রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তক ছন্দ’। এই ছন্দ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বলাকা’ কাব্যে ব্যবহার করেছিলেন। ‘বলাকা’ কাব্যের ছন্দের পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—এটা বেড়া ভাঙা পয়ার। অর্থাৎ পয়ারের বেড়ি ভেঙে ভাবের প্রবহমানতাই কবির কথাতে স্পষ্ট।

মিশ্রকলাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত রীতি নির্ভর অনিয়মিত ও অসম দৈর্ঘ্যের পংক্তি সমন্বিত, চরণান্তিক মিলযুক্ত, পংক্তির পর পংক্তিরতে স্বচ্ছন্দে প্রবাহিত অভিনব ছন্দ বলাকা ছন্দ বা মুক্তক ছন্দ। ইংরেজি Free Verse বা ফরাসি Verse Liber – এর অনুরূপ মনে করে ছন্দাচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন এই ছন্দটিকে ‘মুক্তক’ নাম প্রয়োগ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একে সমর্থনও করেছিলেন।

‘বলাকা’ কাব্য প্রধানত গতিরাগের কাব্য। অকারণ/অবারণ চলার ছন্দই এই কাব্যের বৈশিষ্ট্য আর কাব্যের ছন্দটি এ ভাবকে পরিণত অর্থাৎ ভাবের গতির সঙ্গে ছন্দের গতির মিল রয়েছে। এই কারণে এই ছন্দটিকে ভাবগতিক ছন্দও বলা হয়। বাংলা ছন্দ মুক্তির ক্ষেত্রে অমিত্রাক্ষর ও গৈরিশ ছন্দের অনেক ত্রুটি ছিল কিন্তু মুক্তক ছন্দে সেই ত্রুটি, অসংগতিগুলি নেই বললেই চলে। এর পর্ব, পংক্তি, বৈচিত্র্য, স্তবক, অন্ত্যমিল, প্রবহমানতা প্রভৃতি এই ছন্দকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।

এই ছন্দের বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা সূত্রাকারে আলোচনা করলাম—

এক।। মূলত মিশ্রকলাবৃত্তের এই ছন্দের লয়টি ধীর।

দুই।। এর মাত্রা গণনা রীতি মিশ্রকলাবৃত্ততেই হয়েছে।

তিন।। ছন্দ যতি ও অর্ধযতি সহাবস্থান ঘুচিয়ে ভাবকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ প্রবহমানতা এর মূল লক্ষণ।

চার।। এর পংক্তিগুলি দৈর্ঘ্য অসম। দুই থেকে বাইশ মাত্রা পর্যন্ত জোড় মাত্রার পংক্তি লক্ষ করা যায়। তবে ১৮ মাত্রার পংক্তি আদর্শ পরিমাপ হিসাবে লক্ষ করা যায়।

পাঁচ।। এই ছন্দে চলিত ক্রিয়ার ব্যবহারও অনায়াসে হয়েছে।

ছয়।। ছন্দটি গভীর ভাব বহনের বিশেষ উপযোগী।

সাত।। বলাকা কাব্যে অসম পংক্তির সমাবেশ সত্ত্বেও অন্ত্যমিল দেওয়া হয়েছে। এর ধ্বনি মাধুর্য শ্রুতিকে তৃপ্তি দেয়।

একটা উদাহরণের সাহায্যে ছন্দ রূপটি স্পষ্ট করা যায়—

বৃথা এ ক্রন্দন                     মাত্রা      

বৃথা এ অনল ভরা দুরন্ত বাসনা।                ১৪

রবি অস্ত যায়।                              

অরণ্যতে অন্ধকার, আকাশেতে আলো। ১৪

            সন্ধ্যা নত আঁখি                         

ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে                    ১০

কেবলমাত্র মিশ্রকলাবৃত্ত রীতিতে নয় দলবৃত্ত রীতির মুক্তক রয়েছে ‘বলাকা’ কাব্যে। যেমন ২২, ২৬, ৩১, ৩৩ সংখ্যক কবিতাগুলি দলবৃত্ত রীতির মুক্তক। পরবর্তী কালে ‘পলাতক’ কাব্যে দলবৃত্ত রীতির অভিনবত্ব এসেছে। কলাবৃত্ত মুক্তকও রবীন্দ্র-রচনায় রয়েছে। ‘শ্যামলী’, ‘সেঁজুতি’ প্রভৃতি কাব্যের দু-একটি কবিতায় তার নিদর্শন পাওয়া যায়।

রবীন্দ্র-ভাবসমুদ্রে নানা ভাবতরঙ্গ নিয়ত আন্দোলিত হত—আর তা বাইরে প্রকাশের জন্য কবি ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। সেই প্রকাশের মাধ্যম খুঁজে নিতে কবি সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। ‘বলাকা’ পর্বে এসে তিনি তার ভাব প্রকাশের মাধ্যম রূপে এই মুক্তককে খুঁজে পেয়েছেন। ভাব এবং রূপের এমন ‘হরগৌরী’ মিলন বলাকার পূর্বে ঘটেনি। ‘বলাকা’ পর্বে এসে যেমন রবীন্দ্র-কাব্যে নতুন বাঁকের সৃষ্ট হয়েছে, তেমনি এই কাব্যে ব্যবহৃত ছন্দও  নতুনত্বের দাবীদার হয়ে উঠেছে।