ছোটগল্পকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়:
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আস্তিক, গ্রামীণ এবং মানবধর্মে বিশ্বাসী। গার্হস্থ্য জীবনের রূপকার। পল্লীগ্রামের সাধারণ জীবনের সাধারণ মানুষ নিয়ে তাঁর কারবার। এরা অতি পরিচিত, খুবই বাস্তব। একান্ত পরিচিত অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয় ও চরিত্র প্রকৃতি-সংস্পর্শে বিভূতিভূষণের গল্পে এক অসামান্যতা পেয়েছে। এখানেই তিনি আধুনিক। সাধারণের অন্তরালে তিনি দেখেছেন সৌম্য, শাশ্বত পরিপূর্ণ জীবন। কল্লোল পর্ব প্রথম যুদ্ধোত্তর সংশয় অস্থিরতা ও ‘নেতিবাদী’ তির্যক জীবনদৃষ্টি আশ্রিত কথাসাহিত্য থেকে বাঙালী হৃদয়ের যে নিগূঢ় মুক্তিপিপাসা তা কতকটা চরিতার্থ হয়েছে একদিকে যেমন তারাশঙ্করের, অন্যদিকে তেমনি বিভূতিভূষণের। বলা যেতে পারে তারাশঙ্করের চেয়েও বিভূতিভূষণ সেই পিপাসার যে পানীয় পরিবেশন করেছেন তা আরো স্বচ্ছ, আরও স্নিগ্ধ। বিভূতিভূষণের (১৮৯৪-১৯৫০) সাহিত্যে অধিকাংশ পরিবেশ ও কাহিনি-পরিকল্পনা একান্ত পরিচিত। অতি সাধারণ ও নিরলংকার। নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে বিভূতিভূষণ বাংলা কথাসাহিত্যে এক বিশিষ্ট মৌলিক শিল্পী ব্যক্তিত্বের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে। ‘উপেক্ষিতা’-র স্নেহময়ী বৌ-দিদি থেকে শুরু করে ‘মৌরীফুল’-এর সুশীলা, ‘পথের পাঁচালী’র সর্বজয়া, ‘অপরাজিত’-র লীলা, পটেশ্বরী, ‘দৃষ্টি প্রদীপ’-এর সীতা-হিরণ্ময়ী-মালতী সকলেই শরৎচন্দ্রের ভাবানুসারী। এদের সৃষ্টির পরিবেশে যুক্ত হোল প্রকৃতিজগত। বিভূতিভূষণের কথাসাহিত্য পরিপূর্ণ, সৌম্য, শাশ্বত জীবনচেতনারই ভাষ্যকার। প্রকৃতির সংস্পর্শেই এই কর্মব্যস্ত অগভীর জীবন শাশ্বত রহস্যভরা গহন-গভীর জীবনের অপরূপ মহিমা ও তাৎপর্য লাভ করেছে।
বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’ ১৯২২-এর জানুয়ারীতে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশ পেল। প্রথম গল্পেই নিজস্ব রীতি প্রতিষ্ঠিত। প্রবৃত্তি ও নিয়তি, মানবজীবনে অন্ধ ঝড় ও অমোঘ কার্যকারণের লীলা তিনি যেমন দেখেছেন, তেমনি অলৌকিক অধ্যাত্মবিশ্বাসের ক্রিয়াও দেখেছেন। মানুষের প্রাত্যহিক জীবন তাঁর ছোটগল্পের লক্ষ্য। তাঁর কাছে বাস্তব জগৎ হোল Realism- মাত্র নয়, তার আড়ালে যে জীবন তাকেও তিনি বাস্তব বলেন। মানুষ, প্রকৃতি ও ঈশ্বর—তিনে মিলে বিভূতিভূষণের সাহিত্যলোক গড়ে উঠেছে। এ বিষয়ে ‘স্মৃতির রেখা’য় তাঁর মন্তব্যগুলি লক্ষণীয়। তাঁর এযাবৎ প্রকাশিত গল্পের সংখ্যা ২২৪টি। গল্পগ্রন্থগুলি হোল ‘মেঘমল্লার’, ‘মৌরীফুল’, ‘যাত্রাবদল’, ‘জন্ম ও মৃত্যু’, ‘কিন্নরদল’, ‘বেনীগীর ফুলবাড়ী’, ‘নবাগত’, ‘তালনবমী’, ‘উপখণ্ড’, ‘বিধু মাষ্টার’, ‘কুশলপাহাড়ী’ প্রভৃতি ১৯ টি। মানুষই তাঁর গল্পলোকের প্রধান আকর্ষণ। তিনি বলেছেন “দেশ বেড়িয়ে যদি মানুষ না দেখলুম তবে কি দেখতে বেরিয়েছি?” (অভিযাত্রিক) বাস্তবতা বা রোমান্টিকতার নাম করে কোন খণ্ড দৃষ্টিকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। ‘কুশল পাহাড়ী’ গল্পটি অসাধারণ। মানব-প্রকৃতি-ঈশ্বরের মিলন ঘটেছে এ গল্পটিতে। গল্পের শিল্পকৌশলকে আচ্ছন্ন করে গল্পরচনায় তাঁর নৈপুণ্য সাহিত্য জীবনের প্রথমেই দেখা গেছে। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মেঘমল্লার’-এর অন্তর্ভুক্ত উপেক্ষিতা-উমারানী ঠেলাগাড়ি-খুকীর কান্ত-এর পরিচয়স্থল। প্রমথ বিশী বলেছেন যে ‘এদের মধ্যে গল্প কোথায়? স্পষ্ট আদি-মধ্য-অন্ত নেই। আছে তৃপ্তিদায়ক পরিপূর্ণতার রূপ।’ (রচনাবলী-ভূমিকা, প্রথম খণ্ড) বিভূতিভূষণের গল্পসমগ্র চরিত্র-নির্ভর, কাহিনি-নির্ভর, অলৌকিক, রোমান্টিক, ক্ষণ উদ্ভাসন ভিত্তিক, জীবনধারা ভিত্তিক। মানুষের অন্তর্লোক আবিষ্কারের অভিযানে তিনি সদা উৎসাহী ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে নিপুণ ও নিষ্ঠুর গল্পটি হোল ‘মৌরীফুল’। মুখরা চপল সুশীলা কাজে দোষ দেখলে ক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু স্নেহ কাঙালিনী। অথচ স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ির কাছ থেকে দুটো মিষ্টি কথার প্রত্যাশী হয়েও উপেক্ষিতা। নৌকাপথে আর একটি বউ-এর সঙ্গে সে ‘মৌরীফুল’ সই পাতায়। স্বামীর হাত স্নেহের বদলে চাবুক উঠেছিল। সুশীলা জ্বরে অচৈতন্য, কেউ তাকে দেখলো না। বেগতিক দেখে ডাক্তার এল জবাব দিল। সুশীলার মৃত্যুতে পাড়া জুড়ালো। স্বামী আবার বিয়ে করলো। দজ্জাল সুশীলাকে কে মনে রাখবে? নির্মম নিপুণ অথচ আপাত উদাসীন শিল্পী বিভূতিভূষণ সাহিত্য ক্ষেত্রে বিরল দর্শন।
বিভূতিভূষণের প্রথম দিকের গল্পে মমতাময়ী নারী চরিত্রের প্রাধান্য, শেষদিকে বাউণ্ডুলে বা খ্যাপাটে বা ঈষৎ বিভ্রান্ত আদর্শবাদী পুরুষ চরিত্রের প্রাধান্য। ভণ্ডুলমামা (যাত্রাবদল), ইচুমস্তল (ফকির), কালী চৌধুরী (দৈবাৎ), কবি কুণ্ডুমশায় (বিধু মাস্টার), সিঁদুরচরণ (ক্ষণভঙ্গুর), বারিক মণ্ডল (মুখোশ ও মুখশ্রী) এই জাতীয় ছিটগ্রস্ত কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত চরিত্র। তাঁর সার্থক কাহিনি নির্ভর গল্পগুলির মধ্যে ‘পুঁইমাচা’, ‘এমনিই হয়’, ‘বিপদ’, ‘তিরোলের বালা’ উজ্জ্বল। নির্মম, সহমর্মী ও জীবন সচেতন ছোটগল্পকার বিভূতিভূষণ যে ক্ষেন্তিকে এঁকেছেন তার মূল সারল্য innocence-এ। এর মূল্য দেবার মতো মানুষ সংসারে খুব বেশি নেই। এইসব সাধারণ কিশোর-কিশোরী নিয়েই তাঁর জগৎ। ঘটনাভিত্তিক গল্প রূপে ‘কিন্নরদল’ এবং ‘দ্রবময়ীর কাশীবাস’ উল্লেখযোগ্য। দ্রবময়ী যেন বিভূতিভূষণেরই প্রতিনিধি। লেখকের অপু ভারত পরিক্রমা করে ফিরে এসেছিল নিশ্চিন্তিপুরে। বিভূতিভূষণ পিরে এসেছিলেন বারাকপুর গ্রামে। আর দ্রবময়ী ফিরে এলেন কাশী ধাম ত্যাগ করে গোপীনাথপুরে। কাশীতে বসে স্বপ্নে দেখলেন—তিনটে আমগাছে আম ফলেছে খুব। কাঁঠাল হয়েছে বটে খয়েরখাগী গাছটাতে। কনক বলছে, অ-ঠাকুমা, একটা নেবু দেবা? না, আর কাশীতে থাকা নয়। দ্রবঠাকরুণ ফিরে এসে সবাইকে বললেন, ‘আমার এই বীটেতেই যেন তোদের কোলে শুয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে পারি। কাশী পেরাপ্তিতে দরকার নেই।’ বিভূতিভূষণের জীবনদৃষ্টির অন্যতম মূল সুর এই ভালোবাসার সুর, মমতার সুর। লেখকের মিশ্ররসের গল্প বিখ্যাত। উপাদান হোল অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস, জনশ্রুতি, লোকবিশ্বাস আর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-অনুযায়ী উপাদান। আর আছে প্রকৃতি। এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠ হোল ‘খুঁটি-দেবতা’। লেখকের অন্য বিশেষত্ব রয়েছে রোমান্টিক রসের গল্প সৃষ্টিতে। মেঘমল্লার, নাস্তিক, স্বপ্ন-বাসুদেব, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি হোল উদাহরণ। চিত্রজাতীয় দিনলিপি বা ভ্রমণ জাতীয় গল্পগুলি হোল—ভিড়, হাট, এমনিই হয় প্রভৃতি।
বিভূতিভূষণ ক্রমশ তাঁর ছোটগল্পে বিশ্বসৃষ্টি রহস্য—ভেকধারী জীবন চেতনাকে রূপ দিয়েছেন যা clan vital , নিত্যবাহমান। তাঁর শিল্পসার্থক গল্পগুলির উৎসভূমি আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, গভীর প্রকৃতিবোধ ও প্রবল মানবপ্রীতি। কর্মব্যস্ত অগভীর একঘেয়ে জীবনের অন্তরালে লুকানো সৌম্য আনন্দময় আধ্যাত্মিক জীবন, প্রবল নিঃশব্দ উচ্ছ্বাসময় জীবন মন্দাকিনীর শান্ত প্রবাহ বিভূতিভূষণের ছোটগল্পের মূল উপাদান। তিনি কেবল মাটি ও মানুষের শিল্পী নন, আকাশ ভরা আনন্দলোক ও ঐশী মহিমারও রূপকার। আর তাঁর জীবনদৃষ্টি মর্ত্য-মানবসংসারের প্রতি করুণ মধুর ভালোবাসার গভীর অঞ্চল আলোয় উদ্ভাসিত। তিনি যে ধারণাটিকে অনুভব করতে চেয়েছেন, তা হোল vastness of space and passing time… এই বিপুল রহস্যের অনুধ্যানে জীবনের স্বরূপ উপলব্ধি—বলেছেন সমালোচক মোহিতলাল। (সাহিত্য বিতান)