দলবৃত্ত ছন্দ বা শ্বাসাঘাত ছন্দ বা স্বরবৃত্ত ছন্দ:
মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দের মত সংস্কৃত নির্ভর নয়, বাংলার একান্ত নিজস্ব ছন্দ হল দলবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দ। ছন্দের প্রকৃতি নির্ভর করে মাত্র বিন্যাসের রীতির উপর। যদি প্রত্যেক ছন্দকে একমাত্রা ধরা হয়, তবে সেই ছন্দের প্রকৃতি দলমাত্রিক। যে রীতিতে দলমাত্রায় ছন্দ পর্ব গঠনের উপাদান রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং সেই ছন্দ প্রতি পর্বে সাধারণত দল সংখ্যার সমতা রয়েছে। সেই ঝোঁক প্রধান দ্রুত লয়ের ছন্দটি হল দলবৃত্ত ছন্দ।
বাংলা ভাষার এই প্রাচীন ছন্দটি পূর্বে নানা নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে এই ছন্দের প্রতি পর্বে স্বরধ্বনির প্রাধান্য দেখে এই ছন্দকে ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন ‘স্বরবৃত্ত’ নাম দেন। সাধারণত ছড়ায় ব্যবহৃত হয় বলে ‘ছড়ার ছন্দ’ নামে ছন্দটি পরিচিতি লাভ করেছিল। লোকসাহিত্যে ব্যবহৃত হত বলে ছন্দটিকে কেউ কেউ লৌকিক ছন্দ নামে চিহ্নিত করেছেন। সেই কারণে রবীন্দ্রনাথ এর নাম দিয়েছেন – ‘প্রাকৃত ছন্দ’ আবার পঙক্তির প্রতি পর্বে প্রথমে একটি করে শ্বাসাঘাত বা স্বরাঘাত থাকে বলে ছন্দ বিশেষজ্ঞ অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় ছন্দটির নাম দিয়েছেন ‘শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দ’। কবি মোহিতলাল মজুমদার একে বলেছিলেন 'কথ্যভাষার পর্বভূূূমক ছন্দ’। তারাপদ ভট্টাচার্য একে বলেছিলেন ‘বলবৃত্ত ছন্দ’ অধ্যাপক ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র তাঁরই প্রদত্ত স্বরবৃত্ত নামটি পরিবর্তন করে নাম রাখেন 'দলবৃত্ত ছন্দ'।
দলবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য:
এক।।দলবৃত্ত ছন্দটির প্রতি পর্বে আদি অক্ষরে প্রশ্বর বা শ্বাসাঘাত পড়ে বলে পর্বগুলির দলমাত্রা ছোট ছোট রূপাকৃতি বলে এর লয় দ্রুত।
দুই।।এই ছন্দে মুক্ত দল এবং রুদ্ধ দল এই একমাত্রার হয় দুই-ই একমাত্রার হয়।
তিন।।এই ছন্দে সাধারণত প্রতি পঙক্তির একটি অপূর্ণ পর্ব থাকতে পারে। পূর্ণ পর্বের মাত্রা সংখ্যা চার হয়। কিন্তু কখনও কখনও দুই, তিন, পাঁচ ইত্যাদি পর্বের মাত্রা হতে দেখা যায়। বহুক্ষেত্রে এই ছন্দের প্রত্যেক পর্বে দুইটি উপ পর্ব স্পষ্ট হয়।
চার।।এই ছন্দের একটি লৌকিক রূপ আছে এবং একটি রূপ কথ্য বা চলিতভাষা নির্ভর। তাই এই ছন্দে অনেক সময় জটিলতা প্রকাশ পায়।
পাঁচ।।এই জাতীয় ছন্দের কোন কোন পূর্ণ পর্বের মাত্রার স্থূলতা ঘটে। ছন্দের প্রয়োজনে দলের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে পর্বকে পূর্ণতা দিয়ে চার মাত্রা করা হয়। আবার ভাবের পরে মাত্রা বৃদ্ধি হলে দলের সংকোচন করে পর্বকে পূর্ণ মাত্রায় দলের সমতা আনা হয়ে থাকে।
দলবৃত্ত ছন্দের সঙ্গে কথ্য ভাষার অধিক যোগ থাকার কারণে অনেকে ছন্দটিকে গুরুগম্ভীর ভাব প্রকাশের অনুকূল নয় বলে মনে করতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখের চেষ্টায় গুরুভার বহনেও যে অক্ষম নয় তা প্রমাণিত হয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের ‘পলাতকা’ কাব্যের নাম করা যেতে পারে – যা দলবৃত্ত ছন্দে রচিত হয়েও কাব্যের গভীর বক্তব্যকে উপস্থিত করেছেন। বর্তমানে মিশ্র কলাবৃত্তের মত এই ছন্দের মধ্যে নানা রূপ কল্পের সৃষ্টি হয়েছে। এমন কি এই দ্রুত লয়ের ছন্দের প্রবণতা বজায় রাখা সম্ভব তাও রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন।
একটি উদাহরণের সাহায্যে দলবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট করা যায় –
“কেমন করে / বীর ডুবুরি / সিন্ধু সেঁচে / মুক্তা আনে ৪+৪+৪+৪
কেমন করে / দুঃসাহসী / চলছে উড়ে / স্বর্গ পানে” ৪+৪+৪+৪
বাংলা ছন্দের জনপ্রিয়তা নিয়ে অনেক কবি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে দলবৃত্ত ছন্দটির বৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।